অলক্ষুনে কে?
কোন বাদশা একদা তার সভাসদদের নিয়ে দরবারে বসা ছিলো। এমন সময় কালো বর্ণের এক চোখ কানা ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হল বাদশার সম্মুখে। সবাই অভিযোগ করল, এই লোকটি এমন ধরনের অলক্ষুনে যে, কেউ যদি সকালে উঠে একে দেখে, সেই দিন তাকে অবশ্যই কোন না কোন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হোক। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বাদশা বললেন, চূড়ান্ত বিচার করার আগে আমি নিজেই তা পরীক্ষা করে দেখবো, কাল সকালে সর্বপ্রথম আমি তাকে দেখবো, তারপর অন্য কাজে হাত দেবো। পরদিন সকালে বাদশা যখন ঘুম থেকে উঠলো, দরজা খুলতেই সর্বপ্রথম সেই কানা ব্যক্তিটিকেই দাঁড়ানো দেখতে পেলো। তাকে দেখেই বাদশা পেছনে ফিরে গেলো এবং দরবারে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। পোষাক পাল্টাবার পর বাদশা যখনই জুতোয় পা দিলো, তখনই তাতে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত বিচ্ছু তাকে দংশন করলো।
বাদশা চিৎকার দিয়ে উঠলে সেবকরা তাড়াতাড়ি সবাই ঘটনাস্থলে ছুটে চলে এলো। বিষের প্রভাবে বাদশার দুধে-আলতা মুখাবয়ব নীল রঙ ধারণ করলো। মহলে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়ে গেলো যে, “বাদশা সালামতকে বিচ্ছু দংশন করেছে।” কিছুক্ষণের মধ্যে মন্ত্রী সাহেবও এসে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে শাহী চিকিৎসককে নিয়ে আসা হলো। তিনি অত্যন্ত দক্ষ হাতে বাদশা সালামতের চিকিৎসা শুরু করলেন। কোন রকমে বাদশা প্রাণে বেঁচে গেলো, কিন্তু তবু তাকে কিছু দিনের জন্য রোগ শয্যায় কাটাতে হয়। অবস্থার যখন কিছুটা উন্নতি হলো এবং বাদশাও যখন তার দরবারে গিয়ে বসতে পারলো, তখন কানা ব্যক্তিটিকে পুনরায় দরবারে নিয়ে আসা হলো, যেনো তাকে সাজা শুনানো যায়, কেননা অভিযোগকারীদের অভিযোগ হলো, সে যে অলক্ষুনে সে বিষয়ে স্বয়ং বাদশা সালামতই পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে। সে কান্নাকাটি করে বাদশার কাছে দয়া ভিক্ষা চাইছে যে, আমাকে আমার দেশ থেকে বের করে দিওনা! এ অবস্থা দেখে তার প্রতি জনৈক মন্ত্রীর করুণা সৃষ্টি হলো। তিনি বাদশার নিকট কিছু কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন, তারপর বললেন: বাদশা সালামত! আপনি তাকে সকালে সর্বপ্রথমে দেখেছেন বলে আপনাকে বিচ্ছু দংশন করেছে, তাই সে অলক্ষুনে হিসাবে গণ্য হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন, কারণ সেও সকালে সর্বপ্রথম আপনার চেহারা দেখেছিলো, সেই থেকে সে এখন পর্যন্ত বন্দী দশায় রয়েছে, এখন হয়ত তাকে দেশান্তরের সাজার কথা শুনিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, সত্যিকার অর্থে অলক্ষুনে কে? সে, না কি আপনি? মন্ত্রীর এই কথা শুনে বাদশা নিরুত্তর হয়ে গেলো। সাথে সাথে তিনি কানা কালো ব্যক্তিটিকে কেবল মুক্তিই দিলেন না, বরং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দিলো, আগামীতে তাকে কেউ যদি অলক্ষুনে বলে, তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
বাদশা চিৎকার দিয়ে উঠলে সেবকরা তাড়াতাড়ি সবাই ঘটনাস্থলে ছুটে চলে এলো। বিষের প্রভাবে বাদশার দুধে-আলতা মুখাবয়ব নীল রঙ ধারণ করলো। মহলে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়ে গেলো যে, “বাদশা সালামতকে বিচ্ছু দংশন করেছে।” কিছুক্ষণের মধ্যে মন্ত্রী সাহেবও এসে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে শাহী চিকিৎসককে নিয়ে আসা হলো। তিনি অত্যন্ত দক্ষ হাতে বাদশা সালামতের চিকিৎসা শুরু করলেন। কোন রকমে বাদশা প্রাণে বেঁচে গেলো, কিন্তু তবু তাকে কিছু দিনের জন্য রোগ শয্যায় কাটাতে হয়। অবস্থার যখন কিছুটা উন্নতি হলো এবং বাদশাও যখন তার দরবারে গিয়ে বসতে পারলো, তখন কানা ব্যক্তিটিকে পুনরায় দরবারে নিয়ে আসা হলো, যেনো তাকে সাজা শুনানো যায়, কেননা অভিযোগকারীদের অভিযোগ হলো, সে যে অলক্ষুনে সে বিষয়ে স্বয়ং বাদশা সালামতই পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে। সে কান্নাকাটি করে বাদশার কাছে দয়া ভিক্ষা চাইছে যে, আমাকে আমার দেশ থেকে বের করে দিওনা! এ অবস্থা দেখে তার প্রতি জনৈক মন্ত্রীর করুণা সৃষ্টি হলো। তিনি বাদশার নিকট কিছু কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন, তারপর বললেন: বাদশা সালামত! আপনি তাকে সকালে সর্বপ্রথমে দেখেছেন বলে আপনাকে বিচ্ছু দংশন করেছে, তাই সে অলক্ষুনে হিসাবে গণ্য হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন, কারণ সেও সকালে সর্বপ্রথম আপনার চেহারা দেখেছিলো, সেই থেকে সে এখন পর্যন্ত বন্দী দশায় রয়েছে, এখন হয়ত তাকে দেশান্তরের সাজার কথা শুনিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, সত্যিকার অর্থে অলক্ষুনে কে? সে, না কি আপনি? মন্ত্রীর এই কথা শুনে বাদশা নিরুত্তর হয়ে গেলো। সাথে সাথে তিনি কানা কালো ব্যক্তিটিকে কেবল মুক্তিই দিলেন না, বরং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দিলো, আগামীতে তাকে কেউ যদি অলক্ষুনে বলে, তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
কেউ কি কখনো অলক্ষুনে হতে পারে?
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! কোন ব্যক্তি, স্থান, কাল ও বস্তুকে অলক্ষুনে মনে করাকে ইসলাম বিশ্বাস করে না। এসব কেবল মনেরই খেয়াল মাত্র। আমার আকা আ‘লা হযরত, ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত, মাওলানা শাহ ইমাম আহমদ রযা খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ এর নিকট একবার এ ধরনের প্রশ্ন করা হলো যে, কোন ব্যক্তিকে নিয়ে এই কথা প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে যে, কেউ যদি সকালে তার অলক্ষুনে চেহারা দেখে ফেলে কিংবা কোন কাজে যাবার বেলায় সে সামনে পড়ে, তাহলে অবশ্যই কোন না কোন অসুবিধা ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়। সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে কোন কাজ হয়ে যাওয়ার ভরসা থাকলেও তার ধারণা হয় যে, কোন না কোন বাঁধা কিংবা দুর্গতি তার হবেই, এটি তাদের পরীক্ষিত বিষয়। তারা সবাই এ ধরনেরই ধারণা পোষণ করে যে, কোথাও যাবার বেলায় যদি সে সামনে পড়ে, তবে সে পুনরায় বাড়িতে চলে আসে এবং কিছুক্ষণ পর এই কথা ভেবে নিজের কাজে চলে যায় যে, অলক্ষুনে লোকটি হয়তো এবার সামনে পড়বে না। প্রশ্ন হলো, ওসব লোকদের এই বিশ্বাস এবং কর্মনীতির ব্যাপারে ফায়সালা কী? এতে শরীয়তের কোন বাধা-নিষেধ আছে কি না?
উত্তর: আ‘লা হযরত رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ উত্তরে বললেন: “পবিত্র শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নাই, এটা মানুষের সন্দেহমাত্র। শরীয়তের হুকুম হলো اِذَا تَطَيَّرْتُمْ فَامْضُوْاঅর্থাৎ যখন কোন প্রথা কুধারণা সৃষ্টি করে, তবে সেই অনুযায়ী আমল করবে না।” এটি কেবল হিন্দুয়ানী পদ্ধতি এই অবস্থায় মুসলমানদের উচিৎ “اَللّٰهُمَّ لَاطَيْرَ اِلَّا طَيْرُكَ، وَلَا خَيْرَ اِلَّا خَيْرُكَ، وَلَا اِلٰهَ غَيْرُكَ ” অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! কোন অমঙ্গলই নাই, তবে সবই তোমারই পক্ষ থেকে আর কোন মঙ্গলই নাই, তবে সবই তোমারই পক্ষ থেকে এবং তুমি ছাড়া কোন মাবুদই নাই’ পাঠ করা এবং মহান প্রতিপালকের উপর ভরসা রেখে নিজের কাজে গমন করা। কখনো থামবেন না, ফিরেও আসবেন না। وَاللهُ تَعَالى اَعْلَمُ (ফতোয়ায়ে রযবীয়া, ২৯/ ৬৪১)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
গুনাহের সমষ্টি
কাউকে অলুক্ষণে বলাতে সে মনে ভীষণ কষ্ট পায়, এতে তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার গুনাহও হয়। এই দু’টি কাজই জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার মতো। উল্লেখিত গুনাহ সমূহের নিন্দা সম্বলিত দু’টি বর্ণনা লক্ষ্য করুন এবং আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কাঁপতে থাকুন।
۞ শাহেনশাহে নবুওয়ত, তাজেদারে রিসালাত صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: কেউ যদি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে বলে, যা তার মধ্যে নাই, তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ততক্ষন পর্যন্ত দোযখীদের কাদা, পূঁজ ও রক্ত ইত্যাদিতে ডুবিয়ে রাখবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে উক্ত কথা থেকে ফিরে না আসে। (আবু দাঊদ, কিতাবুল কাদ্বীহা, বাবুন ফিশ শাহাদাত, ৩/ ৪২৭, হাদীস- ৩৫৯৭)
۞ সুলতানে দো জাহান صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: مَنْ اٰذَى مُسْلِمًا فَقَدْ اٰذَانِىْ وَمَنْ اٰذَانِىْ فَقَدْ اٰذَى الله অর্থাৎ যে ব্যক্তি (শরয়ী অনুমতি ছাড়া) কোন মুসলমানকে কষ্ট দেয়, মূলতঃ সে আমাকেই কষ্ট দেয় আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দেয়, সে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকেই কষ্ট দেয়। (আল মুজামুল আওসাত, ২/৩৮৭, হাদীস- ৩৬০৭) আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم কে যারা কষ্ট দেয় তাদের ব্যাপারে ২২তম পারার সূরা আহযাবের ৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللهَ وَرَسُولَهٗ لَعَنَهُمُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত আর আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্চণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। (পারা ২২, সূরা আহযাব, আয়াত ৫৭)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
প্রথা বা রীতির প্রকারভেদ
প্রথা বা রীতি মানে ফাল তথা ইঙ্গিত নেওয়া। অর্থাৎ কোন বস্তু, ব্যক্তি, কাজ, শব্দ বা সময়কে নিজের পক্ষে শুভ বা অশুভ বলে মনে করা। মৌলিক ভাবে তা দুই ধরনের। যথা; ১. অশুভ প্রথা বা রীতি এবং ২. শুভ প্রথা বা রীতি। আল্লামা মুহাম্মদ বিন আহমদ আনসারী কুরতুবী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ তাফসীরে কুরতুবীতে উদ্ধৃত করছেন: শুভ প্রথা হলো, যে কাজের ইচ্ছা পোষণ করেছে, কোন কথা শুনে সেই কাজের পক্ষে প্রমাণ গ্রহণ করা। এটি তখনই হয়, যখন কথাটি শুভ হয়। যদি অশুভ হয়, তাহলে অশুভ প্রথা। শরীয়ত এই কথার নিদের্শ দিয়েছে যে, মানুষ যেনো শুভ প্রথা বা রীতি নিয়ে খুশি থাকে এবং নিজের কাজ আনন্দচিত্তে সম্পূর্ণ রূপে করে। কোন অশুভ কথা শুনলে সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপ না করে। সেই কারণে নিজের কাজও যেন বন্ধ করে না দেয়। (আল জা’মিউ লি আহকামিল কোরআন লিল কুরতুবী, ২৬তম পারা, সূরা আহযাব, ৪নং আয়াতের পাদটিকা ১৬তম অংশ, ৮/১৩২)
শুভ ও অশুভ প্রথা বা রীতির উদাহরণ
শুভ প্রথার উদাহরণ হলো, মনে করুন, আমি কোন কাজে যাচ্ছি, এমন সময় কেউ আমাকে ডাক দিলো, ‘ইয়া রাশীদ’ (হে হেদায়তপ্রাপ্ত) বলে কিংবা ‘ইয়া সাঈদ’ (হে ভাগ্যবান) বলে অথবা ডাক দিলো, ‘হে নেককার’ বলে। আমি মনে মনে বললাম: কতইনা সুন্দর নাম শুনলাম اِنْ شَاءَ الله عَزَّوَجَلّ আমি সফল হবো কিংবা কোন বুযুর্গ ব্যক্তির সাক্ষাৎ হলো। সেটিকে নিজের পক্ষে সৌভাগ্য বলে ধরে নিলাম, মনে মনে ভাবলাম, আমার উদ্দেশ্য সফল হবে। পক্ষান্তরে অশুভ প্রথা বা রীতি হলো, কোন ব্যক্তি সফর করার নিয়্যতে ঘর থেকে বের হলো। কিন্তু একটি কালো বিড়াল তার সামনে দিয়ে রাস্তা পাড় হলো। এবার সেই ব্যক্তিটি মনে মনে বিশ্বাস করে নিলো যে, এটি অশুভ কিছু হওয়ার কারণ, তাকে অবশ্যই কোন না কোন অসুবিধার শিকার হতে হবে, সে সফর না করে ঘরে ফিরে গেলো। এমতাবস্থায় মনে করবেন, লোকটি অশুভ প্রথা বা রীতিতে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের সমাজে অজ্ঞতার কারণে প্রচলিত খারাপ কাজগুলোর মধ্যে কু-প্রথাও একটি। একে কুসংস্কারও বলা হয়ে থাকে। একে আরবিতে طِيَرَةٌ ، طَيْرٌ ، طَائِرٌ বলা হয়। আরবরা طَائِرٌ অর্থাৎ পাখি উড়িয়ে তা থেকে ইঙ্গিত গ্রহণ করতো। পাখিটি ডান দিক দিয়ে উড়লে শুভ ইঙ্গিত হিসেবে নিতো আর বাম দিকে উড়লে অশুভ ইঙ্গিত হিসেবে নিতো। তাছাড়া কাক ডাকলেও অশুভ প্রথা হিসেবে নিতো। তারপর থেকে সাধারণতঃ অশুভ ফালের জন্য طِيَرَةٌ ، طَيْرٌ ، طَائِرٌ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। (তাফসীরে কবীর, ৫/৩৪৪)
আরব দেশের লোকেরা পাখির নাম, ডাক, রঙ এবং সেগুলোর উড়ার দিক থেকে ফাল তথা ইঙ্গিত গ্রহণ করতো। যেমন: ঈগল (শক্তিধর শিকারী পাখি) থেকে মুসিবত, কাক থেকে সফর এবং হুদহুদ (সুন্দর এক ধরনের পাখি) থেকে হেদায়তের ইঙ্গিত গ্রহণ করতো। অনুরূপ পাখি ডান দিক দিয়ে উড়লে শুভ ফাল এবং বাম দিক দিয়ে উড়লে অশুভ ফাল নিতো। (বরিকায়ে মাহমুদিয়া শরহে তরিকায়ে মাহমুদিয়া, বাবুল খামিস ওয়াল ইশরুন, ২/ ৩৭৮)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
শয়তানী কাজ
রাসূলে আকরাম, নূরে মুজাসসাম, শাফিয়ে উমাম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: اَلْعِيَافَةُ وَالطِّيَرَةُ وَالطَّرْقُ مِنَ الْجِبْتِ অর্থাৎ শুভ-অশুভ জানার জন্য পাখি উড়ানো, শুভ অশুভ গণনা করা এবং ﻃـﺮق (অর্থাৎ কঙ্কর নিক্ষেপ করে কিংবা বালির উপর রেখা টেনে ফাল বের করা) শয়তানী কাজ। (আবু দাঊদ, কিতাবুত তিব্ব্, ৪/ ২২, হাদীস- ৩৯০৭)
কু-প্রথা গ্রহণ করা হারাম এবং শুভ ফাল নেওয়া মুস্তাহাব
হযরত সায়্যিদুনা ইমাম মুহাম্মদ আফান্দী রূমী বরকলী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ আত তারিকাতুল মুহাম্মদিয়ায় লিখেন: অশুভ প্রথা গ্রহণ করা হারাম আর নেক ফাল বা শুভ প্রথা গ্রহণ করা মুস্তাহাব। (আত তরিকতুল মুহাম্মদিয়া, ২/১৭, ২৪)
প্রসিদ্ধ মুফাসসির হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ লিখেন: ইসলামের দৃষ্টিতে শুভ প্রথা বা রীতি-নীতি গ্রহণ করা জায়িয, কু-প্রথা বা রীতি-নীতি গ্রহণ করা হারাম।(তাফসীরে নাঈমী। ৯/ ১১৯)
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা
না চাইতেই অনেক সময় মানুষের মনে কু-প্রথার মনোভাব সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই কারো মনে কু-প্রথার কথা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে তাকে গুনাহগার বলা যাবে না। কেননা কেবল মনে মনে খারাপ মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার ভিত্তিতে শাস্তির উপযুক্ত সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্য হলো, কোন মানুষকে তার সামর্থের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া আর এটি শরীয়তের পরিপন্থী। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: আল্লাহ তায়ালা কোন আত্মার উপর বোঝা অপর্ন করেন না, কিন্তু তার সাধ্য পরিমাণ। (পারা ৩, সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬)
হযরত আল্লামা মোল্লা জীঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ এই আয়াতটির ব্যাপারে তাফসীরাতে আহমদিয়ায় লিখেছেন: অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জীবকে সেই বিষয়ের মুকাল্লাফ (অর্থাৎ দায়িত্বশীল) বানান, যা তার শক্তি ও সামর্থের মধ্যে। (তাফসীরাতে আহমদিয়া, ১৮৯ পৃষ্ঠা)
সুতরাং কেউ যদি কু-প্রথার কথা মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে সেটি বাদ দিয়ে দেয়, তবে তার উপর কোন অভিযোগ নাই। কিন্তু সে যদি কু-প্রথার প্রভাবকে বিশ্বাস করে নেয় এবং সেই বিশ্বাসের উপর কাজ বন্ধ করে দেয়, তাহলে গুনাহগার হবে। যেমন ধরুন; কোন কিছুকে অলক্ষুনে বলে মনে করে সফর কিংবা কাজ কর্ম করা থেকে এই মনোভাবে বিরত থাকা যে, এখন আমার ক্ষতিই হবে। তাহলে গুনাহগার হবে। শায়খুল ইসলাম শিহাবুদ্দীন ইমাম আহমদ বিন হাজর মক্কী হাইতামী শাফেয়ী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ স্বীয় কিতাব ‘আয যাওয়াজিরু আনিকতিরাফিল কাবায়ির সম্পর্কে দু’টি হাদীস শরীফ তুলে ধরে লিখেন: প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ থেকে কু-প্রথাকে কবীরা গুনাহে গণ্য করা হয় এবং এটিই সমিচীন যে, যে ব্যক্তি কু- প্রথার প্রভাবে বিশ্বাস রাখে, তার জন্য এই হুকুমটি প্রযোজ্য হওয়া। পক্ষান্তরে এ ধরনের ব্যক্তিদের ব্যাপারে মুসলমান কি না সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। (আযযাওয়াজিরু আনিকতিরাফিল কাবায়ির, বাবুস সফর, ১/ ৩২৬)
করেঁ না তঙ্গ খেয়ালাতে বদ কভি, কর দেয়
শুঊর ও ফিকর কো পাকীযগী আতা ইয়া রব! (ওয়াসায়িলে বখশীশ, ৯৩ পৃষ্ঠা)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
স্পর্শকাতর বিষয়
প্রিয় নবী, রাসূলে আরবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: اَلطِّيَرَةُ شِرْكٌ اَلطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلَاثَاً وَمَا مِنَّا اِلَّا وَلٰكِنَّ اللهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ অর্থাৎ অশুভ ফাল নেওয়া শিরিক, অশুভ ফাল নেওয়া শিরিক, কথাটি তিনি তিনবার বললেন, (অতঃপর ইরশাদ করেন) আমাদের প্রত্যেকেরই এ রকম ধারণা সৃষ্টি হয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসার মাধ্যমে সেটিকে দূর করে দেয়।(আবু দাঊদ, কিতাবুল কাহানাতি ওয়াত তাইর, বাবুন ফিত তাইরাতি, ৪/ ২৩, হাদীস- ৩৯১০)
হযরত সায়্যিদুনা আল্লামা মোল্লা আলী কারী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখেন: অশুভ ফাল নেওয়াকে শিরক সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা জাহেলীয়তের যুগে লোকদের বিশ্বাস ছিলো যে, অশুভ ফালের উপর আমল করাতে তাদের উপকার হয়। কিংবা ক্ষতি ও দুর্দশা দূর হয়ে যায়। অতএব তারা যখন সেই চাহিদা অনুযায়ী আমল করলো, তবে যেনো তারা আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরিক করলো আর এটিকে বলা হয় শিরকে খফী (যা গুনাহ)। যদি কেউ এই মতবাদ পোষণ করে যে, উপকার সাধন ও বিপদে লিপ্ত করানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোন সত্বা রয়েছে, যা একটি স্বতন্ত্র শক্তি, তাহলে সে শিরকে জলী বা প্রকাশ্য শিরিক করলো (যা কুফর)। (মিরকাতুল মাফাতীহ, কিতাবুত তিব্বে ওয়াররাকী, বাবুল ফালি ওয়াত তাইর, ৮/৩৪৯, হাদীস- ৪৫৮৪)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
শিরকে লিপ্ত হয়ে গেলে
মদীনার তাজেদার, হুযুরে আনওয়ার, রাসূলদের সর্দার صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: مَنْ رَدَّتُهُ الطِّيَرَةُ عَنْ شَىْءٍ فَقَدْ قَارَفَ الشِّرْكَ: অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুসংস্কারের কারণে কোন কিছু থেকে ফিরে আসে, সে ব্যক্তি শিরিকে জড়িয়ে গেছে।১ (মুজমাউয যাওয়ায়িদ, কিতাবুত তিব্ব, বাবু ফীমান তাতাইয়ারা, ৫/ ১৮০, হাদীস- ৮৪১৫)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
অশুভ প্রথার বিভিন্ন রূপ
কু-প্রথা বা অশুভ ইঙ্গিত গ্রহণ করা একটি আন্তর্জাতিক রোগ। বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন জিনিস থেকে এমন এমন অশুভ ইঙ্গিত গ্রহন করে যে, মানুষ তা শুনে হতবাক হয়ে যায়। যেমন;
۞কখনো অন্ধ, ল্যাংড়া, কানা এবং কখনো কোন প্রতিবন্ধী লোক দেখে কিংবা কখনো কোন বিশেষ পাখি বা জন্তু দেখে অথবা এর আওয়াজ শুনে অশুভ প্রথার শিকার হয়ে যায়।
۞কখনো কোন সময় বা দিন বা মাসকেও অশুভ মনে করা হয়।
۞কোন কাজের ইচ্ছা করলো। এমন সময় কেউ কাজের পদ্ধতিতে ভাল-মন্দ দেখিয়ে দিলো কিংবা কাজটি গুটিয়ে ফেলতে বললো, এ থেকেও অশুভ প্রথা বের করা হয়, এই তো তুমি বাম হাত ঢুকিয়ে দিলে। কাজটি কি আর হবে!
۞কখনো এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে, কখনো ফায়ার ব্রিগেডের শব্দ শুনেও অশুভ প্রথার শিকার হয়ে যায়।
۞কখনো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নক্ষত্র ও রাশির ফলাফল দেখেও নিজের জীবনে দুঃখ ও দুচিন্তা টেনে আনে।
۞কখনো মেহমান বিদায় নেওয়ার পর ঘরে ঝাড়ু দেওয়াকেও অলক্ষুনে বলে মনে করা হয়।
۞কখনো জুতো খোলার সময় জুতোর উপর জুতো চলে আসাকেও অশুভ মনে করা হয়।
۞কারো কাটা নখ পায়ের নিচে পড়লে মনে করা হয় পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি হবে।
۞বাম চোখ লাফালে বিশ্বাস করে নেয় যে, কোন মুসিবত আসবে।
۞জুমার দিন ঈদ হলে সরকারী শাসনামলের উপর চাপ মনে করা হয়।
۞কখনো বিড়ালের কান্নাকেও অলক্ষুনে বলে মনে করা হয়। কখনো রাতের বেলায় কুকুরের কান্নাকেও।
۞দিনের বেলায় মোরগ ডাকলে অলক্ষুনে ভাবা হয়। এমনকি সেটিকে জবাই করে দেয়া হয়।
۞প্রথম গ্রাহক কিছু না নিয়ে চলে যাওয়াকেও দোকানদার অশুভ মনে করে থাকে।
۞নববধূকে ঘরে তোলার পর যদি পরিবারের কেউ মারা যায়, কিংবা কোন মহিলার যদি কেবল কন্যা সন্তান হতে থাকে, তাহলে সেই মহিলাটির গায়ে ‘অপয়া’ অপবাদের লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়।
۞কোন গর্ভবতী মহিলাকে মৃত ব্যক্তির নিকট আসতে দেওয়া হয়না, এই ভেবে যে, সন্তানের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে।
۞যৌবনে বিধবা হয়ে যাওয়া মহিলাদেরকেও ‘অপয়া’ বলে মনে করা হয়।
۞ আরো মনে করে যে, অযথা কেঁচি চালালে ঘরে ঝগড়া সৃষ্টি হয়।
۞কারো ব্যবহৃত চিরুনী অন্য কেউ ব্যবহার করলে মনে করা হয় দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে।
۞খালি বাসন বা চামচ একটির সাথে অন্যটি ঠোকর খেলে মনে করা হয় ঘরে ঝগড়া-ঝাটি লেগে যাবে।
۞মেঘে যখন বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে, তখন যদি বড় সন্তানটি বাইরে আসে, তবে মনে করা হয় তার উপরই বিদ্যুৎ পতিত হবে।
۞শিশুর দাঁত যদি উল্টা বের হয়, তাহলে নানার বাড়ির লোকেদের (মামা, খালা, নানা, নানী ইত্যাদি) নিকট সেই সন্তান বোঝা স্বরূপ মনে করা হয়।
۞দুগ্ধপোষ্য শিশুর চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে দাঁত বাঁকা হয়ে বের হবে মনে করা হয়।
۞শিশু সন্তান যদি কারো পায়ের নিচ দিয়ে চলে আসে, তাহলে মনে করা হয় যে, তার দৈহিক গড়ন ছোট রয়ে যাবে।
۞শায়িত শিশুর উপর দিয়ে কেউ ডিঙ্গিয়ে গেলে মনে করা হয় তার দৈহিক গড়ন ছোট রয়ে যাবে।
۞আরো মনে করা হয় যে, মাগরিবের পরে দরজার পাশে বসা উচিত নয়। কেননা বালা-মুসিবত চলতে থাকে।
۞ভূমিকম্প চলাকালে পালাবার সময় কেউ যদি মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে মনে করা হয় সে বোবা হয়ে যাবে।
۞রাতের বেলায় আয়না দেখলে মনে করা হয় চেহারায় ভাঁজ পড়ে যাবে।
۞আঙ্গুল মটকালে মনে করা হয় অমঙ্গল আসে।১
[১.আঙ্গুল সমূহ মটকানোর তিনটি বিধান: (১) নামাযের মধ্যে মাকরূহে তাহরীমী এবং নামাযের প্রস্তুতি যেমন; নামাযের জন্য গমন করার সময়, নামাযের জন্য অপেক্ষা করার সময়ও আঙ্গল মটকানো মাকরূহে তাহরীমী। (বাহারে শরীয়ত, ১/৬২৫) (২) নামাযের বাইরে বিনা প্রয়োজনে আঙ্গল মটকানো মাকরূহে তানযিহী এবং (৩) নামাযের বাইরে প্রয়োজনে যেমন; আঙ্গুলে আরাম দেয়ার জন্য আঙ্গুল মটকানো মুবাহ অর্থাৎ মাকরূহ ব্যতিত জায়িয। (রদ্দুল মুহতার, ২/৪৯৩-৪৯৪)]
۞সূর্যগ্রহণকালে গর্ভবতী মহিলা ছুরি দিয়ে কিছু কাটা-কুটি করেনা, কেননা মনে করা হয় এতে সন্তানের হাত অথবা পা কাটা হবে।
۞নবজাতকের কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিংড়ানো যাবেনা, কেননা মনে করা হয় এতে শিশুর দেহে ব্যথা সৃষ্টি হবে।
۞কখনো সংখ্যাকেও অশুভ মনে করা হয় (বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশে যারা বসবাস করে তারা) এই কারণেই বড় বড় দালানগুলোতে ১৩ নম্বরের তলা (ফ্লোর) হয় না। ১২ তলার পরবর্তী তলাকে ১৪ নম্বর সাব্যস্ত করা হয়। অনুরূপ তাদের হাসপাতালগুলোতেও ১৩ নম্বরের সিট বা রুম থাকেনা, কেননা তারা সেই নম্বর টিকে অলক্ষুনে মনে করে।
۞রাতের বেলায় চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ালে কিংবা নখ কাটলে মনে করা হয় যে, অমঙ্গল হবে।
۞মনে করা হয় যে, ঘরের দেওয়াল কিংবা ছাদে পেঁচা বসলে অমঙ্গল হয়। (পক্ষান্তরে পশ্চিমা দেশগুলোতে পেঁচাকে বরকতময় বলে মনে করা হয়)।
۞মাগরিবের আযানের সময় সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দিতে হয়, কেননা মনে করা হয় যে, অন্যথায় বালা-মুসিবত অবতীর্ণ হবে।
উপরোল্লিখিত অশুভ প্রথাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সমাজ, জাতি ও গোষ্ঠীতে বহু ধরনের কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে।
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
কুসংস্কারের ক্ষতিকর দিকসমূহ
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! অশুভ প্রথা মানবের দ্বীনি, দুনিয়াবী উভয় দিক থেকে অতিশয় ভয়ানক, তা মানুষকে শয়তানের ধোঁকায় ফেলে দেয়, তাই সে বড়-ছোট জিনিসকে ভয় করতে থাকে। এমনকি সে তার নিজের ছায়াটিকেও ভয় করতে থাকে। সে এমন এক সন্দেহের মধ্যে বিরাজ করে যে, দুনিয়ার সমস্ত দুর্ভাগ্য কেবল তার জন্যই জমা হয়ে আছে, অথচ সবাই শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করছে। এমন ব্যক্তিরা প্রিয়জনদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখে থাকে, যার ফলে অন্তরে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, কুসংস্কারের বাতেনী রোগের শিকার মানুষ মানসিক ও আত্মিক ভাবে অর্কমন্য হয়ে যায় এবং কোন কাজই তারা সুন্দর ও সুচারুরূপে করতে পারে না। ইমাম আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মদ মাওয়ার্দী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ লিখেন: اِعْلَمْ اَنَّه لَيْسَ شَيْءٌ اَضَرَّبِالرَّأْئِ وَلَا اَفْسَدَ لِلتّدبِيرِ مِن اِعتِقَادِ الطِّيَرَةِ অর্থাৎ জেনে রাখুন, চিন্তা-চেতনার পক্ষে অশুভ প্রথা গ্রহনের চেয়ে অধিক ক্ষতিকর এবং কাজকর্মে বাধাসৃষ্টিকারী কোন কিছু নাই। (আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ্দীন, ২৭৪ পৃষ্ঠা)
অসংখ্য হাদীস শরীফেও অশুভ প্রথার ক্ষতি সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। যেমন;
১। সে আমাদের দলভূক্ত নয়
হুযুর পাক صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم অশুভ প্রথা মান্যকারীদের জন্য নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে গিয়ে এই শব্দগুলো দ্বারা ইরশাদ করেন: لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَلَه অর্থাৎ যে ব্যক্তি অশুভ প্রথা ছড়ায় এবং যে অশুভ প্রথা গ্রহণ করে, তারা আমার দলভূক্ত নহে (অর্থাৎ আমাদের তরিকায় নাই)। (আল মু’জামু কবীর, ১৮/ ১৬২, হাদীস- ৩৫৫ ও ফয়যুল কদীর, ৩/ ২৮৮, হাদীস- ৩২০৬)
২। উচ্চ মর্যাদা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না
রাসূলে আকরাম, নূরে মুজাসসাম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيْهِ مَمْ يَنَلِ الدَّرَجَاتِ العُلٰى مِنْ تَكَهَّنَ اَوِ اسْتَقْسَمَ اَوْ رَدَّهُ مِنْ سَفَرِهٖ طِيَرَةٌ অর্থাৎযার মধ্যে তিনটি বিষয় রয়েছে, সে উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছাতে পারে না। ১. যে ব্যক্তি নিজের ধারণা থেকে অদৃশ্যের কথা বলে (অর্থাৎ ভবিষ্যতের কথা বলে)। ২. ভবিষ্যৎ বাণী করে নিজের ভাগ্য নির্ণয় করে অথবা ৩. অশুভ প্রথা গ্রহণের কারণে সফর ভঙ্গ করে। (তারীখে ইবনে আসাকির, রজা বিন হাইওয়া, ১৮/ ৯৮)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
কুসংস্কারের ভয়ানক পরিণতি
۞যারা কুসংস্কারের বিশ্বাসী, আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভরসায় তারা দুর্বল হয়ে যায়।
۞আল্লাহ তায়ালাকে নিয়ে কুধারণা সৃষ্টি হয়।
۞ভাগ্যের উপর ঈমান দুর্বল হতে থাকে।
۞শয়তানী কুমন্ত্রণার দরজা খুলে যায়।
۞অশুভ প্রথা গ্রহণের কারণে মানুষের মধ্যে সন্দেহ, চিত্তের দুর্বলতা, মনের ভয়, সাহসহীনতা এবং কার্পণ্য সৃষ্টি হয়ে যায়।
۞অনেক ধরনের ব্যর্থতা আসতে পারে। যেমন, কাজের পদ্ধতি সঠিক না হওয়া, ভুল সময়ে বা ভুল স্থানে কাজ করা এবং অপরিনামদর্শী কাজ করা ইত্যাদি। অশুভ প্রথা গ্রহণে অভ্যস্ত মানুষ নিজের ব্যর্থতাকে অশুভ সাব্যস্ত করার মাধ্যমে আত্মসংশোধন থেকেও বঞ্চিত থাকে।
۞অশুভ প্রথা গ্রহণের কারণে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তখন তাদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়।
۞যারা নিজের মাঝে অশুভ প্রথা গ্রহণের দরজা খুলে নেয়, তাদের দৃষ্টিতে সবকিছুই অলক্ষুনে মনে হতে থাকে। কোন কাজে ঘর থেকে বের হলে পথে যদি কালো বিড়াল রাস্তা পাড় হয়, তখন ধারণা করে নেয় যে, আমার কাজ হবেনা, এই বলে ঘরে ফিরে আসে। এক ব্যক্তি সকাল বেলা দোকান খুলতে যাচ্ছিলো, রাস্তায় যদি কোন দুর্ঘটনা দেখে, তখন মনে করে, আজকের দিনটি আমার জন্য অমঙ্গলের, সুতরাং আজ আমার ক্ষতি হবেই। এভাবে তাদের জীবন চলার নিয়ম- নীতি উলট পালট হয়ে যায়।
۞কারো ঘরে পেঁচার শব্দ শোনা গেলো, তখন বলে দিলো, এই ঘরের কেউ মারা যাবে কিংবা পরিবারে ঝগড়া হবে, ফলে সেই পরিবারে এক ধরনের মুসিবত সৃষ্টি হয়।
۞নতুন কর্মচারী যদি ব্যবসায় কাষ্টমার ডিল করতে না জানে এবং অর্ডার হাতছাড়া হয়ে যায়, ফ্যাক্টরীর মালিক তখন তাকে অলক্ষুনে বলে চাকরি থেকে বের করে দেয়।
۞নববধূর হাত থেকে পড়ে কোন জিনিস যদি ভেঙ্গে যায়, তবে তাকে অপয়া মনে করা হয় এবং কথায় কথায় তার মনে কষ্ট দেওয়া হয়।
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! অশুভ প্রথা তথা অশুভ ইঙ্গিত এবং বিভিন্ন ধরনের জাহেরী ও বাতেনী গুনাহ থেকে বাঁচার উৎসাহ সৃষ্টি হওয়ার জন্য আশিকানে রাসূলের মাদানী সংগঠন দা’ওয়াতে ইসলামী’র মাদানী পরিবেশ মহান নেয়ামতের তুলনায় কোন অংশে কম নয়, এর সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত থাকুন, اِنْ شَاءَ الله عَزَّوَجَلّ এর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির জীবনে অভাবিত পরিবর্তন বরং মাদানী পরিবর্তন সাধিত হয়। এই বিষয়ে একটি মাদানী বাহার লক্ষ্য করুন। যেমনটি;
আসমান থেকে কাগজের টুকরা পড়ল
কসবা কলোনীর (বাবুল মদীনা, করাচী) এক ইসলামী ভাইয়ের নিজের বর্ণনা: আমাদের পরিবারে কন্যা সন্তান বেশি ছিলো। চাচাজানের সাত কন্যা, বড় ভাইয়ের নয় কন্যা, আমার বিয়ে হলো, আমার ঘরেও কন্যা সন্তান জন্ম নিলো। সকলের মনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হলো। বর্তমানকার সাধারণ ধারণা অনুযায়ী সকলের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হতে লাগলো যে, কেউ যাদু-টোনা করে আমাদের পরিবারে ছেলে সন্তান হওয়া বন্ধ করে রেখেছে। আমি নিয়্যত করে নিলাম, আমার ঘরে যদি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়, তবে আমি ৩০ দিনের মাদানী কাফেলায় সফর করবো। আমার মাদানী মুন্নীর মা একবার স্বপ্নে দেখলো, আসমান থেকে একটি কাগজের টুকরা এসে তার পাশে পরলো, হাতে নিয়ে দেখলো যে, তাতে লেখা ছিলো ‘বেলাল’। اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَزَّوَجَلّ ৩০ দিনের মাদানী কাফেলার বরকতে আমার ঘরে মাদানী মুন্নার (পুত্র সন্তানের) আগমন হলো! একটি নয় বরং পরবর্তীতে আরো দু’টি মাদানী মুন্না জন্ম নিলো। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ দেখুন, ৩০ দিনের মাদানী কাফেলার বরকতে পুত্র সন্তান জন্ম লাভের এই ধারা কেবল আমি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি, আমাদের পরিবারে যার যার পুত্র সন্তান ছিলো না, সবার ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মাদানী মুন্না (পুত্র সন্তান) জন্ম নিলো। এই বর্ণনা দেওয়ার সময় اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَزَّوَجَلّ আমি এলাকায়ী মাদানী কাফেলার একজন যিম্মাদার হিসাবে কাফেলার বাহারগুলো কুঁড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আ কে তুম বা আদব দেখ লো ফদ্বলে রব মাদানী মুন্নে মিলেঁ কাফেলে মেঁ চলো
খুটি কিসমত খরি গোদ হোগি হরি মুন্না মুন্নীমিলেঁ কাফেলে মেঁ চলো
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! দেখলেন তো আপনারা, মাদানী কাফেলার বরকতে কী ভাবে মনের আশা পূর্ণ হয়, আশার শুকনো ক্ষেতগুলো সবুজ-শ্যামল হয়ে যায়, মনের মৃতপ্রায় কলিগুলো ফুটে ওঠে। নির্ঘাত ধ্বংস থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আনন্দের জীবন লাভ হয়, কিন্তু সর্বদা মনে রাখবেন যে, প্রত্যেকেরই মনের বাসনা পূর্ণ হবে এমনটি নয়। অনেক সময় এমনও হয় যে, মানুষ যা বাসনা করে, তা তার পক্ষে উত্তম নয়। তাই তার সেই বাসনাটি পূরণ করা হয়না। তার আবেদন অনুযায়ী মনের বাসনা পূর্ণ না হওয়াও তার পক্ষে এক প্রকার বিশেষ উপহার। যেমন ধরুন, কেউ পুত্র সন্তানের আবেদন করলো, কিন্তু বার বার তার মাদানী মুন্নীই (কন্যা সন্তান) জন্ম নিচ্ছে আর এটি তার পক্ষে উত্তমই হচ্ছে। যেমন, দ্বিতীয় পারার সূরা বাকারার ২১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
عَسٰى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئًا وَّهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ - وَ عَسٰى أَنْ تُحِبُّوْا شَيْئًا وَّهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ - وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: সম্ভবত তোমাদের নিকট কোন বিষয় অপছন্দ হবে অথচ তা তোমাদের পক্ষে কল্যাণকর; এবং সম্ভবতঃ কোন বিষয় তোমাদের পছন্দনীয় হবে অথচ তা তোমাদের পক্ষে অকল্যাণকর আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না। (ফয়যানে সুন্নাত, ফয়যানে রমযান অধ্যায়, ৭৬৩-৭৬৪ পৃষ্ঠা, ঈষৎ পরিবর্তিত)
অশুভ প্রথা অমুসলিমদের রীতি
কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে অলক্ষুনে সাব্যস্ত করা মুসলমানদের রীতি নয়, এটি হলো অমুসলিমদেরই পুরনো রীতি, এ ধরনের চারটি ঘটনা লক্ষ্য করুন।
১। ফেরআউনীরা হযরত মুসা عَلَيْهِ السَّلَام কে অশুভ মনে করতো
৯ম পারায় সূরা আরাফের ১৩১ নম্বর আয়াতে রয়েছে:
فَإِذَا جَاءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هٰذِهٖ ج وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَّطَّيَّرُوْا بِمُوْسٰى وَمَن مَّعَہٗ ط أَلَا إِنَّمَا طٰئِرُهُمْ عِندَ اللهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: অতঃপর যখন তারা কোন কল্যাণ লাভ করতো, তখন বলতো, ‘এটা আমাদের প্রাপ্য’; আর যখন কোন অকল্যাণ পৌঁছতে তখন মূসা ও তাঁর সঙ্গীদেরকে অমঙ্গলের জন্য দায়ী করতো; শুনে নাও! তাদের অদৃষ্টের অশুভ পরিণাম তো আল্লহরই নিকট রয়েছে; কিন্তু তাদের মধ্যে অধিকাংশই অবগত নয়। (৯ম পারা, সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৩১)
প্রসিদ্ধ মুফাসসির, হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْه এই আয়াতটির টীকায় লিখেন: ফেরআউনীদের উপর যখন কোন ধরনের বিপদ (অনাবৃষ্টি ইত্যাদি) আসতো, তখন তারা মুসা عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام ও তাঁর মুমিন সাথীদের নিয়ে অলক্ষুনে অপবাদ দিতো। তারা বলতো, যখন থেকে এসব লোক আমাদের রাজ্যে প্রকাশ পেয়েছে, তখন থেকে আমাদের উপর বিপদাপদ আসতে থাকে। (মুফতী সাহেব আরো লিখেন) মানুষ বিপদাপদ ও বালা-মুসিবতে পতিত হলে তাওবা করে নেয়। কিন্তু তারা এতোই অবাধ্য ছিলো যে, এতো কিছুতেও তাদের চোখ খোলেনি, বরং তাদের কুফর, অবাধ্যতা ও অমান্যতা আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। আমি যখন তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা ও নেয়ামতরাজি দিয়ে শান্তির জীবন দান করি, তখন তারা বলে, এসব শান্তির জিনিসগুলো তো আমাদেরই, আমরা এসবেরই যোগ্য ও দাবীদার, এই শান্তিপূর্ণ জীবন আমাদের চেষ্টারই ফল। (তাফসীরে নঈমী, ৯/১১৭)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
২। সামূদ জাতির হযরত সালিহ عَلَيْهِ السَّلَام কে অলক্ষুনে ভাবা
হযরত সালিহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام কে সামূদ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়, যাতে তিনি এক আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের প্রতি সবাইকে আহ্বান করেন। তিনি যখন তাদেরকে এর প্রতি আহ্বান করলেন, একটি দল তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করলো। অপর দল তাদের কুফরে অটল রইলো এবং হযরত সালিহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিতে লাগলো, হে সালিহ! আপনি যেই শাস্তির ওয়াদা শুনাচ্ছেন, সেই শাস্তি নিয়ে আসুন, যদি আপনি সত্যিকার রাসূল হয়ে থাকেন। উত্তরে তিনি তাদের বুঝাতেন, তোমরা শান্তির স্থলে অশান্তি আর আযাব কেন কামনা করছো? আযাব অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে কুফর থেকে তাওবা করে ঈমান এনে আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছো না কেন? তবে হয়তো তোমাদের উপর আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করতেন এবং দুনিয়ায় আযাব দিতেন না, কিন্তু জাতি তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। তারা বললো: সেই কারণে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে, অনাবৃষ্টি সৃষ্টি হয়েছে, দূর্ভিক্ষ চলছে। এসব কিছুকে তারা হযরত সালিহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام এর আগমনের দিকে ইঙ্গিত করে এবং তাঁর আগমনকে অলক্ষুনে বলে মনে করে তারা বলে: আমরা আপনাকেও আপনার সাথীদের অলক্ষুনে মনে করছি। হযরত সায়্যিদুনা সালিহ عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام বললেন: তোমাদের ভাল মন্দ আল্লাহ তায়ালার নিকট, কিন্তু তোমরা ফিতনায় পড়ে গেছো অর্থাৎ তোমাদের পরীক্ষা চলছে, অন্যথায় তোমাদের দ্বীনের কারণে আযাবে লিপ্ত হবে। (সূরাতুন নামাল থেকে সংক্ষেপিত, ১৯তম পারা, আয়াত ৪৫ থেকে ৪৭ ও তাফসীরে খাযায়িনুল ইরফান, ৭০৬ পৃষ্ঠা)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
৩। হতভাগ্য ব্যক্তিরা মুবাল্লিগদেরকে অলক্ষুনে বলে
হযরত সায়্যিদুনা ঈসা عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام তাঁর দুইজন হাওয়ারি তথা অনুসারী ছাদিক ও ছুদূককে ইন্তিকিয়ায় (একটি জায়গার নাম) পাঠিয়েছিলেন সেখানকার লোকদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য, কেননা তারা মূর্তি পূজারী ছিলো। তাঁরা উভয়ে যখন নগরীর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো, তখন ছাগল ছড়ানো অবস্থায় এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলে, লোকটির নাম ছিল হাবীব নাজ্জার, সে তাঁদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। তাঁরা বললো: আমরা হযরত ঈসা عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام এর প্রেরিত দূত। আমরা এসেছি তোমাদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য, তোমরা মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে এক আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো। হাবীব নাজ্জার নিদর্শন দেখতে চাইলো, তাঁরা বললো: নিদর্শন হলো, আমরা রোগীকে আরোগ্য দান করি, অন্ধকে দৃষ্টি দান করি, কুষ্ঠ রোগীর রোগ দূরীভূত করি। হাবীব নাজ্জারের এক ছেলে দুই বৎসর ধরে অসুস্থ ছিলো। তাঁরা তার উপর হাত বুলিয়ে দিলো, সে ভাল হয়ে গেলো, হাবীব নাজ্জার ঈমান গ্রহণ করলো, এই ঘটনাটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো, এমনকি অনেক মানুষ তাঁদের হাতে আরোগ্য লাভ করলো, সংবাদ শুনে বাদশা তাঁদের ডেকে আনলো। বললো: আমাদের উপাস্যগুলো ছাড়াও কি অন্য কোন উপাস্য আছে? তাঁরা বললো: হ্যাঁ, তিনি আপনাকে এবং আপনার উপাস্যদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। তারপর সবাই তাঁদের ধাওয়া করলো, মারলো এবং উভয়কে বন্দি করে নিয়ে গেলো। তারপর হযরত ঈসা عَلٰی نَبِیِّنَاوَعَلَیْہِ الصَّلوٰۃُ وَالسَّلام হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে পাঠালেন। তিনি একজন ভিনদেশী বেশে নগরে প্রবেশ করলেন, তিনি বাদশার সভাসদ ও অনুচরদের সাথে সখ্যতা ও সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে বাদশা পর্যন্ত পৌঁছালেন, বাদশার নিকটও তিনি নিজের একটি স্থান তৈরি করে নিলেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, বাদশা তাঁর হাতে এক ধরনের বশ হয়ে গেছে, একদিন তিনি বাদশাকে বললেন: যে দুইজন লোককে আপনি বন্দী করেছেন, তাদের কথাগুলো কি আপনি শুনেছেন, তারা কী বলতে চায়? বাদশা বললো: না তো, শুনিনি। তারা নতুন দ্বীনের নাম নেওয়ায় হঠাৎ আমার মাথায় রাগ চেপে গেলো। শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বললেন: বাদশা জনাবের আজ্ঞা হলে তাদের ডেকে আনা যেতে পারে। দেখা যেতে পারে তাদের কাছে কী রয়েছে? অতএব তাদের দুইজনকে আনা হলো। হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন: তোমাদের কে পাঠিয়েছে? তাঁরা বললেন: আল্লাহ তায়ালা! যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল জীবের জীবিকা দান করেন, যাঁর কোন অংশীদার নাই। হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বললেন: সেই আল্লাহ তায়ালার সংক্ষিপ্ত গুণাবলী বর্ণনা করুন। তাঁরা বললো: তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করেন, তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী আদেশ দেন। হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বললেন: তোমাদের কোন নিদর্শন আছে কি না? তাঁরা বললো: বাদশা যা চান! তখন বাদশা এক অন্ধকে ডেকে আনলো। তাঁরা দোয়া করলে সে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলো। হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বাদশাকে বললেন: এখন উচিৎ হবে আপনি আপনার উপাস্যদের বলুন, তারাও যেনো এরূপ করে দেখায়, যাতে করে আপনার এবং তাদের সম্মান প্রকাশ পায়। বাদশা হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে বললো: আপনার কাছে গোপন করার কী আছে, আমাদের উপাস্যরা দেখেও না, শোনেও না, লাভ-ক্ষতি কিছু করতেও পারে না। তারপর বাদশা সেই দুইজন হাওয়ারীকে উদ্দেশ্য করে বললো: তোমাদের মাবুদ যদি মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন, তবে আমি তাঁর উপর ঈমান আনবো। তাঁরা বললো: আমাদের মাবুদ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। বাদশা তখন এক কৃষকের ছেলেকে নিয়ে এলো, যে সাত দিন আগে মারা গিয়েছিলো, দেহ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো, তাঁদের দোয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে জীবিত করে দিলেন, সে ওঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো: আমি মরেছিলাম মুশরিক অবস্থায়, আমাকে জাহান্নামের সপ্তম স্তরে রাখা হয়েছে, আমি আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি, যে দ্বীনে আপনারা রয়েছেন, সেই দ্বীন অত্যন্ত ক্ষতিকর, আপনি ঈমান গ্রহন করে নিন এবং বলতে লাগলো: আসমানের দরজা খুলে গেছে, তারপর এক সুন্দর যুবক দেখা গেলো, সেই যুবকটি এই তিনজনের পক্ষে সুপারিশ করলো। বাদশা বললো: কোন তিনজন? সে বললো: শামঊন এবং এই দুইজন বন্দী। এ কথা শুনে বাদশা বিস্মিত হয়ে গেলো। হযরত শামঊন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ যখন দেখতে পেলেন যে, তাঁর কথায় বাদশার মনে প্রভাব সৃষ্টি করেছে, তখন তিনি বাদশাকে উপদেশ দিলেন। বাদশা ঈমান আনয়ন করলো এবং তার জাতির কিছু লোকও ঈমান আনয়ন করলো আর কিছু লোক আনলো না। তারা বললো: আমরা তোমাদেরকে অলক্ষুনে বলে মনে করি, তোমরা যদি তোমাদের দ্বীন থেকে সরে না আসো, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদের পাথর ছুঁড়ে মারবো এবং অবশ্যই তোমরা আমাদের হাতে কঠিন শাস্তির শিকার হবে। তাঁরা বললো: তোমাদের ধ্বংস (অর্থাৎ তোমাদের কুফর) তোমাদেরই সাথে, তোমরা কি তাতেই বিগড়ে গেছো যে, তোমাদেরকে বুঝানো হয়েছে? আর তোমাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হয়েছে? বরং তোমরা হলে সীমালঙ্ঘনকারী লোক। তোমরা রয়েছো পথভ্রষ্টতা আর অবাধ্যতায়। এটিই হল সত্যিকার বড় অমঙ্গল। (তাফসীরে খাযায়িনুল ইরফান, সূরা ইয়াসীন, আয়াত ১৩ থেকে ১৯, ৮১৬ পৃষ্ঠা)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
৪। ইহুদী ও মুনাফিকরা নবী করীম ﷺ এর আগমনকেও অশুভ মনে করতো
সূরা নিসার ৭৮ নম্বর আয়াতে রয়েছে:
وَاِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِ اللهِ ۚ وَاِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِكَ ط قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ اللهِ ط فَمَالِ هٰؤُلَاءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُوْنَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًا
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: এবং তাদের নিকট যদি কোন কল্যাণ পৌঁছে, তবে বলে, ‘এটা আল্লাহর নিকট থেকে’ এবং তাদের নিকট যদি কোন ক্ষতি পৌঁছে তবে বলে, ‘এটা হুযুরের দিক থেকে এসেছে।’ আপনি বলুন! ’সবকিছু আল্লাহর নিকট থেকেই’। কাজেই, ঐসব লোকের কী হলো? তারা কোন কথা বুঝছে বলে মনে হয় না। (৫ম পারা, সূরা নিসা, আয়াত ৭৮)
প্রসিদ্ধ মুফাসসির, হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ আয়াতটির টীকায় লিখেন: ‘হুযুর সাইয়্যিদে আলম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم যখন হিজরত করে মদীনা শরীফ আগমন করলেন এবং ইহুদীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তখন অধিকাংশ ইহুদী তাঁর বিরোধিতায় মেতে উঠলো। আবার কেউ কেউ ‘তাকিয়া’ করে (অর্থাৎ নিজেদের কুফরকে গোপন রেখে) কলেমা পাঠ করে মুসলমানদের মধ্যে এসে ঢুকে পড়ে এবং তাদের বিভিন্ন ক্ষতিসাধন করতে থাকে। যার শাস্তি স্বরূপ সেখানে কখনো কখনো বৃষ্টি হতো না, কখনো কখনো ফল ধরতো না, যেমনটি বিগত উম্মতদের অবস্থার মতোই, তখন অভিশপ্ত ইহুদী ও মুনাফিকরা বললো: (نَعُوذُ بِالله) তাঁর (প্রিয় নবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ) আগমনে আমাদের এখানে বরকত কমে গেছে। এসব বিপদ তাঁর কারণেই হয়েছে। তাদের এ ধরনের উক্তির খন্ডনে এই আয়াত শরীফটি অবতীর্ণ হয়। (মুফতী সাহেব আরো লিখেন) এখনো কোন কোন কাফির মুসলমানদেরকে অলক্ষুনে বলে থাকে বরং অনেক মুর্খ ব্যক্তি মুসলমান নামাযী পরহিযগারদেরকে অলক্ষুনে বলে থাকে আর তাদের নেক আমলকে অমঙ্গল বলে। এগুলো হচ্ছে ঐসব শয়তানদেরই পরিত্যক্ত বংশধর। (তাফসীরে নঈমী, ৫/ ২৪০)
প্রিয় নবী ﷺ এর আগমনে ইয়াসরিব পরিণত হয় মদীনায়
মুফতী সাহেব আরো লিখেন: সেই পবিত্র যুগে সত্যবাদীরা তো বলতেনই, প্রিয় নবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর আগমনে আমাদের ইয়াসরিব “মদীনা শরীফ” হয়ে গেছে। এখানকার মাটি আরোগ্য দানকারী, এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর হয়ে গেছে।
কিন্তু ইহুদী, মুনাফিক ও অবিশ্বাসীরা বলতো: প্রিয় নবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর আগমনে মদীনার বরকতসমূহ উধাও হয়ে গেছে...। আ’লা হযরত رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কত সুন্দরইনা বলেছেন:
কোয়ি জান বস কে মেহেক রহি কিস দিল মেঁ উস সে খটক রহি!
নেহিঁ উস কে জলওয়ে মেঁ ইয়াক রহি কাহিঁ ফুল হে কহিঁ খার হে
আমরা নিবেদন করলাম,
তাইবা কি যী’নত উন হি কে দম সে কাবা কি রওনক উন কে কদম সে!!
কাবা হি কিয়া হে সারে জাহাঁ মেঁ ধূম হে উন কি কওন ও মকাঁ মেঁ!!
অর্থাৎ প্রিয় নবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর কদমের সদকায় মদীনার অধিবাসীরা পরস্পর একই আত্মায় পরিণত হয়ে গেছে। হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর আগমনে মদীনা সমগ্র দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু ও আশ্রয় স্থলে পরিণত হয়ে গেছে। প্রিয় নবী, রাসূলে আরবী صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর কারণে মদীনা ঐতিহাসিক স্থানে পরিণত হয়, এর হাজার হাজার ইতিহাস রচিত হয়ে যায়। হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর কারণে মদীনার প্রশংসায় হাজার হাজার কসীদা লিখা হয়, কোন নগরই এমন সম্মান প্রাপ্ত হয়নি। হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর কারণে মদীনার প্রতি সমস্ত মানব-জাতির আকর্ষণ হয়ে গেছে। হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর কদমের সদকায় মদীনাকে মদীনা মুনাওয়ারা বলা হয়, এসব মর্যাদা তাঁর বরকতে হয়েছে। (তাফসীরে নঈমী, ৫/ ২৪৩)
কর কে হিজরত ইহাঁ আ’গেয়ে মোস্তফা রওশনী আজ ঘর ঘর মদীনে মেঁ হে
জানতে হো মদীনা হে কিউঁ দিল পছন্দ দোনোঁ আলম কা দিলবর মদীনে মেঁ হে
নূর কি দেখো বরসাত হে চার সো কিয়া সমাঁ কেয়ফ আ’ওয়ার মদীনে মেঁ হে
হে মদীনে কা রুতবা বড়া খুলদ সে কিউঁ কেহ মাহবূবে দাওর মদীনে মেঁ হে
সবজে গুম্বদ কা আত্তার মনযর তো দেখ কিস কদর কেয়ফ আ’ওয্র মদীনে মেঁ হে
(ওয়াসায়িলে বখশীশ)
অমঙ্গলের সম্পর্ক নিজের দিকে করা উচিৎ
সূরা নিসার ৭৯ নম্বর আয়াতে রয়েছে:
مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللهِ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَّفْسِكَ
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: হে শ্রোতা! তোমার নিকট যা কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর নিকট থেকে এবং যে অকল্যাণ পৌঁছে তা তোমার নিজের পক্ষ থেকেই। (৫ম পারা, সূরা নিসা, আয়াত ৭৯)
সদরুল আফাযিল আল্লামা মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ আয়াতটির টীকায় লিখেন: তুমি এমন সব গুনাহ করেছো যে, তুমি এর যোগ্য সাব্যস্ত হয়েছো।
মাসআলা: এখানে অমঙ্গলের সম্পর্ক বান্দার প্রতি ‘রূপক’ এবং পূর্বে যা উল্লেখ হয়েছে তা ছিলো ‘প্রকৃত’। কোন কোন তাফসীর কারকগণ বলেন: মন্দকাযের্র সম্পর্ক বান্দার প্রতি শিষ্টাচারে (আদবের) নিয়ম হিসেবে। মোটকথা হলো, বান্দা যখন প্রকৃত কর্তার প্রতি অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার প্রতি দৃষ্টিপাত করবে, তখন প্রত্যেক কিছুই তাঁরই পক্ষ থেকে বলেই ধারনা করবে আর যখন উপায় উপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে, তখন অমঙ্গলগুলোকে নিজের প্রবৃত্তির ফলশ্রুতি বলে বুঝতে পারবে। (খাযায়িনুল ইরফান, ১৭৭ পৃষ্ঠা)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
মুশরিকরা অশুভ প্রথা গ্রহণ করতো
হাফেজ শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে আলী বিন হাজার আসকালানী শাফেঈ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ লিখেন: জাহেলীয়তের যুগে মুশরিকরা পাখিদের উপর ভরসা করতো, তাদের কেউ যখন কোন কাজে বের হতো, তখন সে পাখিদের দিকে দেখতো, পাখি যদি তার ডান দিক দিয়ে উড়তো, তখন সে তা মঙ্গল বলে গ্রহণ করতো এবং নিজের কাজে চলে যেতো আর যদি পাখি তার বাম পাশ দিয়ে উড়তো, তখন সে তা অমঙ্গল বলে গ্রহণ করতো এবং কাজে না গিয়ে ফিরে আসতো। কখনো কখনো তারা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে যাত্রাকালে প্রথমে নিজে পাখি উড়িয়ে দিতো। পাখিটির উড়ার উপর ভরসা করে কাজে যাওয়া না যাওয়া নির্ধারণ করতো। যখন পবিত্র শরীয়ত এসে গেলো, তখন থেকে তাদেরকে সেই পদ্ধতি থেকে সরিয়ে আনা হয়। (ফতহুল বারী, কিতাবুত তিব্ব, বাবুত তিয়ারতি, ১১/ ১৮০)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
এটি তোমাদের মনের সন্দেহ
হযরত সায়্যিদুনা মুয়াবিয়া বিন হাকাম رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বর্ণনা করেন: আমি হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দরবারে আরয করলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم জাহেলীয়তের যুগে আমরা কিছু কাজ করতাম। (আপনি আমাকে সেগুলো সম্পর্কে বলুন) আমরা জ্যোতিষীদের কাছে যেতাম। মদীনার তাজেদার صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّمইরশাদ করলেন: তোমরা জ্যোতিষীদের কাছে যাবে না। আমি বললাম: (আমরা পাখি ইত্যাদি থেকে) ফাল নিতাম। তিনি صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন: এটি হলো এক ধরনের মনেরই খেয়াল মাত্র, যা তোমরা মনের মধ্যে অনুভব করে থাকো। কিন্তু এটি তোমাদেরকে (তোমাদের প্রয়োজনের নিকট) যেনো বাধা না দেয়। (মুসলিম, কিতাবুস সালাম, বাবু তাহরীমিল কাহানাতি ওয়া ইতিয়ানিল কাহান, ১২২৩ পৃষ্ঠা, হাদীস-৫৩৭ ও মিরকাতুল মাফাতীহ, কিতাবুত তিব্ব ওয়ার রাকী, আল ফছলুল আউয়াল, ৮/৩৫৮)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
পাখিরাও তাদের তকদীর অনুযায়ীই উড়ে
হযরত সায়্যিদুনা আবু বুরদা رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বর্ণনা করেন: আমি হযরত সায়্যিদাতুনা আয়েশা সিদ্দীকা رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهَا এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলাম: আমাকে এমন কোন হাদীস শরীফ শুনান, যা আপনি রাসূলে পাক صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর নিকট থেকে নিজে শুনেছেন। উম্মুল মুমিনীন رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهَا উত্তর দিলেন; রাসূলুল্লাহ صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: পাখিরা তাদের তকদীর অনুযায়ীই উড়ে(*) আর হুযুর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم শুভ ফাল তথা শুভ ইঙ্গিত গ্রহন করাকে পছন্দ করতেন।(মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৯/ ৪৫০, হাদীস- ২৫০৩৬)
(*এই কারণে পাখিরা ডানে বামে উড়লে কোন প্রভাব হয়না।)
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
--------
--------
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা “মুহাম্মদ ইলয়াস আত্তার” কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত ৯৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত "অশুভ প্রথা" নামক রিসালার ১-২১ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই রিসালাটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখুন। অন্যকে উপহার দিন।
ইসলামীক বাংলা বইয়ের লিংক এক সাথে পেতে এখানে ক্লিক করুন
কুসংস্কার বিষয়ক লিখাটির দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব