কসমের সংজ্ঞা
কসমকে আরবি ভাষায় ‘ইয়ামীন’ বলা হয়। অর্থাৎ ডান দিক। যেহেতু আরব লোকেরা কসম করা ও গ্রহণ কালে সাধারণতঃ পরস্পর ডান হাত মিলাত, তাই একে ইয়ামীন বলে থাকে। ইয়ামীন শব্দটি আবার ‘ইয়ামন’ শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এর অর্থ হল বরকত ও শক্তি। কসমে যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলার বরকতপূর্ণ নামও ব্যবহার করা হয়, এবং তা দ্বারা নিজের উক্তিতে শক্তি প্রদান করা হয়, তাই তাকে ইয়ামীন বলা হয়। অর্থাৎ বরকতপূর্ণ ও শক্তিশালী উক্তি বা কথা। (মিরআতুল মানাজীহ্, ৫ম খন্ড, ৯৪ পৃষ্ঠা)।
শরীয়াতের পরিভাষায় সেই চুক্তিকেই কসম বলা হয়, যার মাধ্যমে শপথকারী কোন কাজ করা বা না করা সম্পর্কে কঠিন ও মজবুত ইচ্ছা প্রকাশ করে। (দুররে মুখতার, ৫ম খন্ড, ৪৮৮ পৃষ্ঠা)। উদাহরণ স্বরূপ, কেউ বলল: ‘আল্লাহর কসম, আমি আগামী কাল তোমার সব ঋণ পরিশোধ করে দিব’ -তাহলে এটি কসম।
কসম তিন প্রকার
কসম তিন প্রকার। যেমন; (১) লাগভ, (২) গুমুস্, ও (৩) মুন্আকিদ।
(১) লাগ্ভ হল: অতীত কিংবা বর্তমান কোন বিষয়ে নিজের ধারণার (অর্থাৎ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে) শুদ্ধ মনে করে কসম করা, অথচ সেই কথা বাস্তবতার বিপরীত। যেমন: কোন ব্যক্তি কসম করল, ‘আল্লাহর কসম! যায়দ ঘরে নেই।’ তার জানা মতে যায়েদ ঘরে বিদ্যমান নেই। সে কিন্তু নিজের ধারণা অনুযায়ী সত্য কসমই করেছে। বাস্তবে কিন্তু যায়েদ ঘরে ছিল। তাহলে এই কসমটিকে লাগ্ভ বলা হবে। এ ধরনের কসম মাফযোগ্য। এই কসমের কাফ্ফারা দিতে হবে না।
(২) গুমুস হল: অতীত কিংবা বর্তমান কোন বিষয়ে জেনে- বুঝে মিথ্যা কসম করা। যেমন, কেউ কসম করল: ‘আল্লাহর কসম! যায়েদ ঘরে আছে।’ অথচ সে জানে যে, যায়েদ ঘরে নেই। এরূপ কসমকে গুমুস বলা হবে। শপথকারী জঘন্য ধরনের গুনাহ্গার হবে। তার উপর ইস্তেগফার ও তাওবা করা ফরজ। কিন্তু কাফ্ফারা দিতে হবে না।
(৩) মুনআক্বিদ হল: ভবিষ্যতের জন্য কসম করা। যেমন, কেউ কসম করল,‘আল্লাহর কসম! আমি আগামীকাল অবশ্যই তোমাদের ঘরে আসব।’ কিন্তু সেদিন সে এল না। তাহলে সে কসম ভঙ্গ করল। তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সে গুনাহ্গারও সাাব সাব্যস্ত হবে। (ফতোওয়ায়ে আলমগিরী, ২য় খন্ড, ৫২ পৃষ্ঠা)
মোটকথা হল: শপথকারী যদি অতীত কিংবা বর্তমান কালের কোন বিষয়ে কসম করে, তাহলে হয়ত সেই কসম সত্য হবে, না হয় মিথ্যা হবে। সত্য হলে কোন অসুবিধা নেই।
মিথ্যা হয়ে থাকলে, সে যদি তা তার ধারণা মোতাবেক সত্য জেনে করে থাকে, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। অর্থাৎ গুনাহ্ও নেই, কাফ্ফারাও নেই। অবশ্য সে যদি আগে থেকেই জানত যে, সে মিথ্যা কসমই করছে, তাহলে সে গুনাহ্গার হবে। কিন্তু কাফফারা দিতে হবে না। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার বা না করার শপথ করে, আর সে যদি কসম পূর্ণ করে দেয়, তাহলে তো ভাল কথা। অন্যথায় কাফফারা দিতে হবে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে কসম ভঙ্গ করার কারণে গুনাহ্গারও হবে। (এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে হবে)।
মিথ্যা কসম করা কবীরা গুনাহ্
মদীনার তাজেদার,রাসুলদের সরদার, হুযুরে আসওয়ার صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে শির্ক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কোন প্রাণী হত্যা করা আর মিথ্যা কসম করা কবীরা গুনাহ্।” (বুখারী, ৪র্থ খন্ড, ২৯৫ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৬৬৭০)
সর্বপ্রথম শয়তান মিথ্যা কসম করেছিল
হযরত সায়্যিদুনা আদম ছফিউল্লাহ্ عَلَيْه السَّلَام কে সিজদা না করার কারণেই শয়তান অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়েছিল। তাই সে তাঁর (আদম عَلَيْه السَّلَام এর) ক্ষতি সাধন করার ফন্দিতে সুযোগ খুঁজছিল। হযরত সায়্যিদুনা আদম ও হাওয়া عليهم السلام কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন: ‘তোমরা উভয়ে জান্নাতে অবস্থান কর। যা যা ইচ্ছা হয় আনন্দ ভরে খাও। কিন্তু ওই বৃক্ষটির দিকে গমন করবে না। শয়তান কোনভাবে আদম ও হাওয়া عَلَيْهِمُ السَّلَام এর নিকট এসে বলল: ‘আমি কি আপনাদেরকে ‘শজরে খুলদ’টি (চিরজীবি হতে পারার বৃক্ষটি) দেখিয়ে দিব?’ হযরত সায়্যিদুনা আদম عَلَيْه السَّلَام অগ্রাহ্য করে দিলেন। এবার শয়তান কসম করল: ‘আমি আপনাদের শুভাকাংখী!’ এঁরা (আদম ও হাওয়া) মনে করলেন যে, আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম কে করতে পারে। এই ভেবে হযরত সায়্যিদাতুনা হাওয়া عليه السلام তা সামান্য খেলেন। অতঃপর হযরত আদম ছফিউল্লাহ্ عَلَيْهِ السَّلَام কে খেতে দিলেন। তিনিও খেয়ে নিলেন। (তাফসীরে আবদুর রাজ্জাক, ২য় খন্ড, ৭৬ পৃষ্ঠা)। যেমন: ৮ম পারার সূরা আরাফের ২০ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে:
فَوَسۡوَسَ لَہُمَا الشَّیۡطٰنُ لِیُبۡدِیَ لَہُمَا مَا وٗرِیَ عَنۡہُمَا مِنۡ سَوۡاٰتِہِمَا وَ قَالَ مَا نَہٰکُمَا رَبُّکُمَا عَنۡ ہٰذِہِ الشَّجَرَۃِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَا مَلَکَیۡنِ اَوۡ تَکُوۡنَا مِنَ الۡخٰلِدِیۡنَ ﴿۲۰﴾
وَ قَاسَمَہُمَاۤ اِنِّیۡ لَکُمَا لَمِنَ النّٰصِحِیۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “(২০) অতঃপর শয়তান তাদের মনে এই আশংকা সঞ্চয় করলো যে, তাদের সম্মুখে অনাবৃত করে দেবে তাদের লজ্জার বস্তুগুলো, যা তাদের থেকে গোপন ছিল এবং বলল, তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালক এই বৃক্ষ থেকে এই জন্য নিষেধ করেছেন যে, তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা চিরজীবি হয়ে যাবে। (২১) এবং তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল, ‘আমি তোমাদের উভয়ের হিতাকাঙ্খী'। সদরুল আফাজিল হযরত আল্লামা মাওলানা মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ তাফসীরে খাযায়িনুল ইরফানে লিখেছেন: অর্থ এই যে, ইবলিস শয়তান মিথ্যা কসম করে হযরত সায়্যিদুনা আদম عَلَيْهِ السَّلَام কে ধোঁকা দিয়েছিল, আর সর্বপ্রথম মিথ্যা কসমকারী ছিল ইবলিসই। হযরত আদম عَلَيْهِ السَّلَام এর ধারণাতেও ছিল না যে, আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে কেউ কসম করে মিথ্যা কথা বলতে পারে। তাই তিনি তার কথায় বিশ্বাস করেছিলেন। কারো হক নষ্ট করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথকারী জাহান্নামী। রাসুলে করীম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “যে ব্যক্তি কসম করে কারো হক নষ্ট করে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেন, তার উপর জান্নাত হারাম করে দেন। আরজ করা হল: ইয়া রাসুলাল্লাহ্ صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم! তা যদি নগণ্য বা অল্প জিনিসই হয়ে থাকে? ইরশাদ করলেন: যদিও পীলূর একটি ডালও হয়ে থাকে।” (মুসলিম, ৮২ পৃষ্ঠা, হাদীস: ২১৮) পীলূ এক জাতীয় বৃক্ষ বিশেষ। যেটার ডাল ও শেঁকড় দিয়ে মিস্ওয়াক বানানো হয়।
মিথ্যা কসমকারী হাশরে হাত-পা কাটা অবস্থায় হবে
জনৈক হাজরামী (ইয়ামনের হাজরামওত নগরীর বাসিন্দা) আর এক কিন্দী (কিন্দা সম্প্রদায়ের লোক) মদীনার তাজেদার, রাসুলদের সরদার, নবী করীম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দরবারে ইয়ামনের এক খন্ড জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে হাজির হল। হাজরামী বলল: হে আল্লাহর রাসুল صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم! আমার জমিটি তার পিতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন তা এই লোকটির হাতে রয়েছে। এটা শুনে নবীয়ে মুকাররাম, নূরে মুজাসসাম, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার কি কোন সাক্ষী আছে? সে বলল: নেই। কিন্তু আমি তার নিকট হতে কসম নিব, সে আল্লাহ্ তা‘আলার নামে কসম করে বলুক যে, যে জমিটি তার পিতা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তা যে আমার জমি সে বিষয়ে সে জানে না। কিন্দী লোকটি কসম করার জন্য প্রস্তুত হল। এমন সময় রাসুলে আকরাম, শাহানশাহে বনী আদম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন: “যে ব্যক্তি (মিথ্যা) কসমের মাধ্যমে কারও সম্পদ দখল করবে, সে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে হাত-পা কাটা অবস্থায় উপস্থিত হবে। এই বাণীটি শুনে কিন্দী লোকটি বলে দিল: জমিটি তারই (হাজরামীরই)।”(সুনানে আবু দাঊদ, ৩য় খন্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৩২৪৪)।
প্রসিদ্ধ মুফাস্সির, হাকীমুল উম্মত, হযরত মুফতি আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ উক্ত হাদীসের টীকায় লিখেছেন: ! এই প্রভাব সেই পবিত্র ফয়েজসমৃদ্ধ জবানের। মাত্র দুইটি কথায় কিন্দী লোকটির মনের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেল, আর সত্য কথা বলে দিয়ে জমি সম্পর্কে দাবি প্রত্যাহার করল। (মিরআতুল মানাজীহ্, ৫ম খন্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৪০৩)।
সাতটি জমির হার (মালা)
সূদের মাধ্যমে অন্যের জায়গায় অবৈধ দখল করে ঘর-বাড়ি নির্মাণকারী লোকেরা, অন্যের পক্ষ হতে ঠিকায় প্রাপ্ত ফসলী জমি-জমা হস্তক্ষেপকারী কৃষকেরা এবং খেয়ানতকারী জমিদারেরা যেন তাড়াতাড়ি তাওবা করে নেয়। যাদের যাদের হক নষ্ট করেছে বা দখল করেছে সেগুলো যেন শীঘ্র ফিরিয়ে দেয়। কারণ, মুসিলম শরীফে ছরকারে নামদার, মদীনার তাজেদার, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “যে ব্যক্তি অন্যের এক বিঘত পরিমাণ জমিও অবৈধ পন্থায় ভোগ করবে, কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত জমিনের মালা পরিয়ে দেওয়া হবে।” (সহীহ মুসলিম, ৮৬৯ পৃষ্ঠা, হাদীস: ১৬১০)।
জনসাধারণের গমনাগমনের রাস্তা অযথা ঘেরাও করবেন না। কেউ কেউ সাধারণ গমনাগমনের রাস্তা -ঘাট অযথা ঘেরাও করে থাকেন। যা লোকজনের ভোগান্তির কারণ হয়। যেমন: (১) ঈদুল আযহার দিনগুলোতে কুরবানীর পশু বিক্রি করার জন্য, ভাড়ায় রাখার জন্য, কিংবা জবাই করার জন্য কোথাও কোথাও অযথা সম্পূর্ণ রাস্তাই ব্যবহার করে। (২) লোকজনের কষ্ট হয় এমন পর্যায়ে রাস্তায় ময়লা ইত্যাদি ফেলে। ভবন নির্মাণ ইত্যাদির জন্য অযথা ইট, বালি, কংকর ইত্যাদি স্তুপ করে রাখে। এমনিভাবে নির্মাণ কাজ শেষে বেঁচে যাওয়া সামগ্রী মাসের পর মাস সেখানে ফেলে রাখা হয়। (৩) বিয়ে-শাদীতে, ভোজের আয়োজনে, কিংবা যে কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে, মেজবান ও ইত্যাদি বিভিন্ন উপলক্ষে রাস্তায় ডেক পাকানো হয়ে থাকে। এতে কখনো কখনো মাটি গর্ত হয়ে যায়। পরে তাতে কাদা ও দুর্গন্ধময় পানি জমে মশা ইত্যাদি জন্মায়, আর রোগ ছড়ায়। (৪) সাধারণের গমানাগমনের রাস্তাগুলো খনন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজন শেষ হওয়ার পর ভর্তি করে সমতল করে দেওয়া হয় না। (৫) বসবাসের জন্য কিংবা ব্যবসার জন্য অবৈধ হস্তক্ষেপে জায়গা দখল করে নেয়। এতে করে লোকজনের রাস্তা ছোট ও সংকীর্ণ হয়ে যায়। এসবের জন্য এটি চিন্তার বিষয়।
দা’ওয়াতে ইসলামীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাকতাবাতুল মদীনা কর্তৃক প্রকাশিত ৮৫৩ পৃষ্ঠা সম্বলিত ‘জাহান্নামে মেঁ লে জানে ওয়ালে আমাল’ নামক কিতাবের ১ম খন্ডের ৮১৬ পৃষ্ঠায় ইমাম ইবনে হাজর মক্কী শাফেয়ী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কবীরা গুনাহ্ ২১৫-তে এই কর্মকান্ডকে কবীরা গুনাহ্ বলে আখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: সাধারণ মানুষের গমনাগমনের রাস্তায় শরীয়াত-বিরুদ্ধ ভাবে অবৈধ হস্তক্ষেপ করা কিংবা এমনভাবে দখল করে রাখা বা ব্যবস্থা নেওয়া যাতে লোকজনের অসুবিধা হয়, এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন: এতে করে লোকজনের ক্ষতি, ভোগান্তি এবং অন্যায়ভাবে তাদের হক নষ্ট করা পাওয়া যাচ্ছে। রহমতে আলম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর বাণী: “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমি নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিল, কিয়ামতের দিন ততটুকু পরিমাণ করে সাত স্থরের জমির মালা বানিয়ে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে।” (সহীহ্ বুখারী, ২য় খন্ড, ৩৭৭ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৩১৯৮)।
মিথ্যা কসম ঘরকে বিরান করে দেয়
মিথ্যা কসমের ক্ষতিসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে আমার আকা আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ আহমদ রযা খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন: মিথ্যা কসম ঘরকে বিরান করে দেয়। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬০২ পৃষ্ঠা) অন্য এক জায়গায় লিখেন: অতীতের কথার উপর জেনে শুনে মিথ্যা শপথকারীর উপর যদিও এর কোন কাফ্ফারা নেই। (কিন্তু) তার শাস্তি হল যে, জাহান্নামের ফুটন্ত সমুদ্রে নিমজ্জিত করা হবে। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ১৩ তম খন্ড, ৬১১ পৃষ্ঠা)।
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! একটু ভাবুন! আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যিনি সব কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন, যাঁর কাছে কিছুই গোপন নয়, এমনকি অন্তর সমূহের ভাবগুলোও যিনি ভালভাবে জানেন, যিনি রহমান, যিনি রহীম, যিনি কাহহার, যিনি জাব্বার সেই বিশ্ব প্রতিপালকের নাম নিয়ে মিথ্যা কসম করা কত বড় মুর্খতা হতে পারে! তাও আবার পার্থিব কোন সাময়িক উপকার প্রাপ্তির এবং কিছু টাকা-পয়সার জন্য।
ইহুদীরা রাসুলের শান গোপন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করত। ইহুদী পাদ্রী এবং তাদের নেতা আবু রাফে, কেনানা বিন আবিল হুকাইক, কাআব বিন আশরাফ, হুবাই বিন আখতাব প্রমূখ আল্লাহ্ তা‘আলার সেসব প্রতিশ্রুতিগুলো গোপন করে ফেলেছিল যা রহমতে আলম, রাসুলে মুহতারাম, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর উপর ঈমান আনার সম্পর্কে তাওরাত শরীফে বর্ণিত হয়েছিল। এভাবে যে, তারা সেগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছিল এবং তদস্থলে নিজেদের পক্ষ থেকে তাদের হাতে অন্য কিছু লিখে দিয়েছিল, আর মিথ্যা কসম খেয়ে বলত, এসব আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। এ সব তারা তাদের দলের মুর্খদের পক্ষ হতে ঘুষ ও ধন অর্জনের জন্যই করেছিল তাদের সম্পর্কে এই আয়াতে মোবারাকাটি নাযিল হয়:
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَشۡتَرُوۡنَ بِعَہۡدِ اللّٰهِ وَ اَیۡمَانِہِمۡ ثَمَنًا قَلِیۡلًا اُولٰٓئِکَ لَا خَلَاقَ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ وَ لَا یُکَلِّمُہُمُ اللّٰهُ وَ لَا یَنۡظُرُ اِلَیۡہِمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ لَا یُزَکِّیۡہِمۡ ۪ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۷۷﴾
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও নিজেদের কসমের বিপরীতে তুচ্ছ বিনিময় গ্রহণ করে, আখিরাতে তাদের জন্য কোন অংশ নেই এবং আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিনে না তাদের সাথে কথা বলবেন,না দৃষ্টিপাত করবেন এবং না তাদেরকে পবিত্র করবেন আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (পারা: ৩, সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৭৭) (তাফসীরে খাযেন, ১ম খন্ড, ২৬৫ পৃষ্ঠা)
নীল চক্ষুবিশিষ্ট মুনাফিক
আবদুল্লাহ ইবনে নব্তল্ (নামের জনৈক) মুনাফিক (ছিল) যে নবী করীম, রউফুর রহীম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দরবারে উপস্থিত থাকত, আর এখানকার সব কথা ইহুদীদের নিকট পাচার করত। একদা প্রিয় নবী صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم দরবারে উপস্থিত’ ছিলেন। তিনি ইরশাদ করেন: “এক্ষুণি একজন লোক আসবে, যার অন্তর খুবই কঠিন। সে দেখে শয়তানের চোখে। কিছুক্ষণ পর আব্দুল্লাহ্ ইবনে নব্তল্ এল, তার চোখগুলো নীল ছিল।” নবী করীম صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم তাকে ইরশাদ করলেন: “তুমি আর তোমার সাথীরা আমাকে গালি দাও কেন?” তখন সে কসম খেয়ে বলল: সে এরূপ করে না। সে তার সাথীদের নিয়ে এল। তারাও কসম করল: ‘আমরা আপনাকে গালি দেইনি।’ এই ঘটনায় নিচের আয়াতটি নাযিল হয়:
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا قَوۡمًا غَضِبَ اللّٰهُ عَلَیۡہِمۡ ؕ مَا ہُمۡ مِّنۡکُمۡ وَ لَا مِنۡہُمۡ ۙ وَ یَحۡلِفُوۡنَ عَلَی الۡکَذِبِ وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۴﴾
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “আপনি কি তাদের দেখেননি যারা এমন লোকদের বন্ধু হয়েছে যাদের উপর আল্লাহর গজব রয়েছে? তারা না তোমাদের মধ্য থেকে, না তাদের মধ্য থেকে। তারা বুঝে-শুনে মিথ্যা শপথ করে। (পারা: ২৮, সূরা: মুজাদালা, আয়াত: ১৪) (খাযায়িনুল ইরফান)
জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ হবে
বর্ণিত আছে: কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা‘আলার সামনে আনা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিবেন। সে আবেদন করবে: হে আল্লাহ! আমাকে কী কারণে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? ইরশাদ হবে: তোমাকে এ কারণেই জাহান্নামে পাঠানো হচ্ছে যে, তুমি ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার পর নামায পড়তে, আর আমার নামে মিথ্যা শপথ করতে। (মুকাশাফাতুল কুলুব, ১৮৯ পৃষ্ঠা)
মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের জন্য বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে
হযরত সায়্যিদুনা আবু যর গিফারী رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ হতে বর্ণিত: আল্লাহর মাহবুব, দানায়ে গুয়ুব, মুনাযযাহি আনিল উয়ুব, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “তিন ব্যক্তি এমন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে না কথা বলবেন, না তাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি দান করবেন, না তাদের পবিত্রতা দান করবেন, বরং তাদের জন্য কঠিন বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” তিনি বলেন: আল্লাহর হাবীব, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এ কথাগুলো তিনবার করে ইরশাদ করেছেন। এরপর আমি আরজ করলাম: তারা তো (তাহলে) ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেছে। তারা কারা? তিনি صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করলেন: (১) যে ব্যক্তি লুঙ্গী অহংকার সহকারে ঝুলিয়ে পরিধান করে, (২) যে ব্যক্তি উপকার করে খোঁটা দেয় এবং (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে পণ্য বিক্রি করে। (সহীহ মুসলিম, ৬৭ পৃষ্ঠা, হাদীস: ১৭১ (১০৬))
মিথ্যা কসমের কারণে বরকত উঠে যায়
উক্ত বর্ণনা থেকে বিশেষ করে ব্যবসায়ী ভাইদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, যারা মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রি করে থাকেন, পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করে খারাপ ও নষ্ট পণ্য চড়া দামে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করার জন্য একের পর এ কসম করতে থাকে, এতে কোন রকমের লজ্জা ও সংকোচ অনুভব করে না, তাদের চিন্তা - ভাবনা করা উচিত যে, কিয়ামতের দিনের সুপারিশকারী, দোজাহানের মালিক-মুখতার, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “মিথ্যা কসমের মাধ্যমে পণ্য তো বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু বরকত উঠে যায়।” (কানযুল উম্মল, ১৬তম খন্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৪৬৩৭৬) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে: “কসম পণ্য বিক্রয় করিয়ে দেয়, তবে বরকত উঠিয়ে দেয়।” (বুখারী শরীফ, ২য় খন্ড, ১৫ পৃষ্ঠা, হাদীস: ২০৮৭) প্রসিদ্ধ মুফাস্সির, হাকীমুল উম্মত, হযরত মুফতি আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ উক্ত হাদীসটির টীকায় লিখেন: বরকত উঠে যাওয়া মানে আগামীতে ব্যবসায় পন্ড হয়ে যাওয়া অথবা ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেওয়া। অর্থাৎ যদি তুমি মিথ্যা কসম খেয়ে প্রতারণামূলক অন্যকে ক্রুটিপূর্ণ কোন পণ্য বিক্রি করে থাক, সে হয়ত একবারই প্রতারিত হবে, দ্বিতীয়বার কিন্তু আর আসবে না। কাউকে আসতেও দিবে না অথবা যে টাকাটা তুমি তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছ তাতে বরকত হবে না। কারণ, হারাম উপার্জনে বরকত নেই। (মিরআতুল মানাজীহ্, ৪র্থ খন্ড, ৩৪৪ পৃষ্ঠা)
শুকরের মত লাশ
দা’ওয়াতে ইসলামীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাকতাবাতুল মদীনা কর্তৃক প্রকাশিত ৩২ পৃষ্ঠা সম্বলিত ‘কাফন চোর’ নামক রিসালায় উল্লেখ রয়েছে: কোন এক সময় খলিফা আবদুল মালিকের কাছে ভীত-শঙ্কিত অবস্থায় এক কাফন চোর এসে বলল: জাহাঁপনা! আমি একজন অত্যন্ত গুনাহ্গার ব্যক্তি। আমি জানতে চাই যে, আমার গুনাহ্ ক্ষমা হওয়ার কোন রাস্তা আছে কি না? খলিফা বললেন: তোমার গুনাহ্ কি আসমান-জমিন থেকেও বড়? সে বলল: হ্যাঁ! বড়। খলিফা বললেন: তোমার গুনাহ্ কি লওহ ও কলম থেকেও বড়? সে বলল: হ্যা! বড়। খলিফা জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার গুনাহ কি আরশ ও কুরছি থেকেও বড়? জবাব দিল: হ্যাঁ! বড়। খলিফা এবার বললেন: ভাই! তোমার গুনাহ তো আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে অবশ্যই বড় হবে না? এ কথা শোনার সাথে সাথে লোকটির মনের পূঞ্জীভূত বাধভাঙ্গা জোয়ার চোখের অশ্রু হয়ে অনর্গল ভাবে ঝরতে আরম্ভ করল। সে অঝোর নয়নে কান্না করতে লাগল খলিফা বললেন: এবার একটু জানতে পারি কি তোমার গুনাহটি কী? প্রশ্নের জবাবে সে বলল: হুযুর! আপনাকে বলতে আমার বড় লজ্জাবোধ হচ্ছে। তবু বলছি, এতে করে হয়ত আমার তাওবা করার কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই বলে সে তার ভয়ংকর কাহিনী বলতে আরম্ভ করল। বলল: জাহাঁপনা! আমি হচ্ছি একজন কাফন চোর। আজ রাতে আমি পাঁচটি কবর হতে শিক্ষা অর্জন করেছি এবং তাওবা করার নিয়্যত করেছি। অতঃপর লোকটি পাঁচটি কবরের শিক্ষামূলক অবস্থার কথা বণর্না করল। একটি কবরের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে সে জানাল, কাফন চুরি করার উদ্দেশ্যে আমি যেই কবরটি খনন করলাম, হৃদয়-বিদারক এক দৃশ্য দেখতে পেলাম। দেখলাম, মুর্দার চেহারাটি শুকরের মুখের মত হয়ে গেছে। আর সে গলায় শিকলবদ্ধ ছিল। অদৃশ্য থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, সে মিথ্যা কসম করত আর হারাম রুজি উপার্জন করত। (তাজকিরাতুল ওয়ায়েজীন, ৬১২ পৃষ্ঠা)
অন্তরে কালো বিন্দু
খাতামুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আ’লামীন, হুযুর পুরনূর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “যে ব্যক্তি কসম করে আর সাথে মাছির পাখা পরিমাণও মিথ্যা মিলিয়ে দেয়, তবে সেই কসমটি তার অন্তরে কিয়ামত পর্যন্ত কালো একটি বিন্দু সৃষ্টি হয়ে থাকবে।” (ইত্হাফুস সাদাতি লিয যুবাইদী, ৯ম খন্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা)
কসম কেবল সত্যের উপরই করা যেতে পারে
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! জাগ্রত হোন! কেঁপে উঠুন! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলার শাস্তি সহ্য করার মত নয়। অতীতে মিথ্যা কসম করে থাকলে অতি শীঘ্রই্ তাওবা করে নিন। এ কথা ভালভাবে মনে রাখবেন যে, প্রয়োজন সাপেক্ষে কসম যদি করতেই হয়, তাহলে কেবল সত্য কসমই করবেন।
মুসলমানের কসম বিশ্বাস করে নেওয়া উচিৎ
কোন মুসলমান যদি আমাদের সামনে কোন বিষয়ে কসম করে তাহলে ভাল ধারণা রেখে আমাদের উচিৎ তার কসমকে বিশ্বাস করে নেওয়া। ইমাম শরফুদ্দীন নববী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন: ‘মুসলমান ভাইয়ের কসমকে বিশ্বাস করা আর তা পূর্ণ করা মুস্তাহাব। শর্ত হল তাতে ফিত্না ইত্যাদির আশঙ্কা না থাকা।’ (শরহে মুসলিম লিন নববী, ১৪তম খন্ড, ৩২ পৃষ্ঠা)
তুমি চুরি করোনি
হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ থেকে বর্ণিত, আল্লাহর মাহবুব, দানায়ে গুয়ুব, মুনাযযাহি আনিল উয়ুব, হুযুর صَلَّی اللّٰه تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন: “(হযরত) ঈসা ইবনে মরিয়ম এক ব্যক্তিকে চুরি করতে দেখে তাকে বললেন: তুমি চুরি করেছ। সে বলল: যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, তার কসম! কখনো না। তখন (হযরত) ঈসা عليه السلام বলেন: আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি আর আমি নিজেকে নিজে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলাম। (সহীহ্ মুসলিম, ১২৮৮ পৃষ্ঠা, হাদীস: ২৩৬৮)
মুমিন কীভাবে আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করতে পারে!
আল্লাহু আকবার! আপনারা দেখলেন তো! হযরত সায়্যিদুনা ঈসা عليه السلام কসমকারীর সাথে কীরূপ উদার আচরণ করলেন। প্রসিদ্ধ মুফাস্সির, হাকীমুল উম্মত, হযরত মুফতি আহমদ ইয়ার খান رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ সেই কসমকারী লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কে হযরত সায়্যিদুনা ঈসা রূহুল্লাহ عليه السلام এর পবিত্র উদারতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন: অর্থাৎ এই কসমের কারণে আমি তোমাকে সত্য জানলাম। কারণ, কোন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার নামে মিথ্যা কসম করতে পারে না। কেননা, তার আল্লাহ্ তা‘আলার নামের মহত্ববোধ কাজ করে। আমি নিজের ভ্রান্ত ধারণা বলে মেনে নিচ্ছি যে, আমার চোখ ভূল দেখেছে। (মিরআত, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬২৩ পৃষ্ঠা) আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত তাঁর উপর বর্ষিত হোক, আর তাঁর সদকায় আমাদের বিনা হিসাবে ক্ষমা হোক।
কুরআন উঠানো কসম কি না?
পবিত্র কুরআনের কসম খাওয়া কসমই।অবশ্য কেবল কুরআন শরীফ উঠিয়ে কিংবা সামনে রেখে অথবা কুরআনে হাত রেখে কোন কথা বলা কসম নয়। ফতোওয়ায়ে রযবীয়ার ১৩তম খন্ডের ৫৭৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে: মিথ্যা বিষয়ে পবিত্র কুরআনের কসম করা জঘন্যতম কবীরা গুনাহ্। সত্য বিষয়ে কুরআনুল করীমের কসম করাতে কোন সমস্যা নেই। প্রয়োজন সাপেক্ষে উঠাতেও পারবে। কিন্তু এটি কসমকে অত্যন্ত দৃঢ়তা দান করে। বিশেষ কোন কারণ ও প্রয়োজন ছাড়া এ কাজ না করা উচিৎ। তাছাড়া ৫৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে: হ্যাঁ, কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে কিংবা তাতে হাত রেখে কোন কথা বলা যদি শব্দগতভাবে কসম ও শপথের সাথে না হয়ে থাকে, তাহলে তা হলফে শরয়ী বা শরীয়াত সম্মত কসম হবে না। (অর্থাৎ কেবল কুরআন শরীফ উঠানো কিংবা তাতে হাত রাখাকে শরীয়াত মতে কসম আখ্যা দেওয়া যাবে না।) যেমন; কেউ বলল: ‘আমি কুরআন শরীফে হাত রেখে বলছি, এমন এমন করব।’ পরে সে তা করল না। তাই সেটি যেহেতু কসমই হয়নি,তাই কাফ্ফারা দিতে হবে না। (আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে অধিক জ্ঞাত) ।
দুইটি শিক্ষণীয় ফতোয়া
(১) মদ্যপায়ী কুরআন উঠিয়ে কসম করল, আবার ভেঙে ফেলল!!! ফতোওয়ায়ে রযবীয়ার ১৩তম খন্ডের ৬০৯পৃষ্ঠায় এক মদ্যপায়ী সম্পর্কে শরীয়াতের বিধান জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করা হল: কোন ব্যক্তি চারজন ব্যক্তির সামনে কুরআন শরীফ উঠিয়ে শপথ করেছে যে, আগামীতে সে মদ পান করবে না। পরে কিন্তু পান করেছে। এই প্রশ্নটির বিস্তারিত জবাবের শেষের দিকে আ’লা হযরত رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন: সে যদি কুরআন উঠিয়ে কুরআনের নামে শপথ করে থাকে কিংবা আল্লাহ্ তা‘আলার নামে কসম করে থাকে, আর তা মুখে উচ্চারণ করে থাকে, পরে কসম ভেঙ্গে দেয়, তাহলে তার উপর কাফ্ফারা আবশ্যক। আর সে যদি কুরআন শরীফ উঠিয়ে কসম খেয়ে থাকে, তাহলে ব্যাপারটি বড়ই জঘন্য। কারণ, সে কুরআন উঠিয়ে তার বিপরীত পুনরায় মদ পান করেছে। এতে করে বিষয়টি কুরআন শরীফের অবমাননা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সে পবিত্র কুরআনের মহত্বের শানকে অপমাণিত করেছে। তাই এই জঘন্য কর্মকান্ডের জন্য (অর্থাৎ কসম শব্দ উচ্চারণ করেনি, কেবল কুরআন মজীদ উঠিয়েছে) কাফ্ফারা দিতে হবে না। বরং এ জন্য তার আবশ্যক যে, আর দেরি না করে তাওবা করে নেওয়া, আর সেই মন্দ কাজ (মদ পান করা) ভবিষ্যতে আর না করার দৃঢ় সংকল্প পোষণ করা।অন্যথায় সে পুনরায় আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বেদনাদায়ক শাস্তি এবং জাহান্নামের আগুনের জন্য অপেক্ষা করুক, আল্লাহর পানাহ! আর সে যদি মুখে কসম শব্দ উচ্চারণ না করে থাকে, বরং সেই কুরআন উঠানোকেই কসম হিসাবে সাব্যস্ত করে থাকে, তাহলে সেই কসমের বিধানও সে রকমই। অর্থাৎ কাফ্ফারা নেই। বরং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির অপেক্ষা করুক।
(২) মিথ্যা শপথকারীকে জাহান্নামের টগবগ করা সমুদ্রে ডুবানো হবে
প্রশ্ন: খোদার নামে মিথ্যা কসম করার কারণে কি কাফফারা দিতে হবে? একই সময়ে যদি কয়েক বার করে আল্লাহ্ তা‘আলার নামে মিথ্যা কসম করে থাকে, তাহলে কাফ্ফারা কি একবারই দেবে? না কি প্রতিবারের কসমের জন্য একটি একটি করে দিবে?
উত্তর: অতীতের কোন বিষয়ে জেনে-শুনে মিথ্যা কসম করাতে কোন কাফ্ফারা দিতে হবে না। এ রকম মিথ্যা কসমের শাস্তি হচ্ছে, তাকে জাহান্নামের ফুটন্ত সমুদ্রে ডুব দেওয়ানো হবে, আর যদি ভবিষ্যতের কোন বিষয় নিয়ে কসম করে থাকে, আর তা পূরণ না করে থাকে, তাহলে কাফ্ফারা দিতে হবে। একবার কসম করলে কাফ্ফারা একবার দিবে। দশবার করলে দশবার। (আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে অধিক জ্ঞাত)
অত্যাধিক কসম করার নিষেধাজ্ঞা
২য় পারার সূরা বাকারার ২২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন: কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “এবং আল্লাহকে তোমাদের শপথগুলোর (এ মর্মে) নিশানা বানিয়ে নিওনা।” সদরুল আফাজিল হযরত আল্লামা মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ উক্ত আয়াতের টীকায় লিখেছেন: কিছু মুফাস্সির এও বলেছেন যে, এই আয়াত দ্বারা অধিক হারে কসম খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা সাব্যস্ত হয়। (হাশিয়াতুস সাবী, ১ম খন্ড, ১৯০ পৃষ্ঠা) হযরত সায়্যিদুনা ইবরাহীম নাখায়ী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেছেন: ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা কখনো কসম ও ওয়াদা করলে আমাদের মুরব্বীরা আমাদের পিটাতেন।’ (সহীহ্ বুখারী, ২য় খন্ড, ৫১৬ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৩৬৫১)
তু ঝুটি কসমো ছে মুঝ কো সদা বাচা ইয়া রব!
না বাত বাত পে খাওঁ কসম খোদা ইয়া রব।
👉কসম বিষয়ে বাকি অংশ: কসম সম্পর্কিত, কাফফারা সম্পর্কিত
--------
লেখাটি হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত “কসম সম্পর্কিত মাদানী ফুল" নামক বই থেকে সংগৃহীত।
ইসলামিক বাংলা বইয়ের লিংক এক সাথে পেতে এখানে ক্লিক করুন।
মাদানী চ্যানেল দেখতে থাকুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for supporting.