রোযা ভঙ্গকারী ১৪ টি কারণ
১. পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যায়; যদি রোযাদার হবার কথা স্মরণ থাকে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
২. হুক্কা, সিগারেট, চুরুট ইত্যাদি পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যায়, যদিও নিজের ধারণায় কণ্ঠনালী পর্যন্ত ধোঁয়া পৌছেনি। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)
৩. পান কিংবা নিছক তামাক খেলেও রোযা ভেঙ্গে যায়। যদিও আপনি সেটার পিক বারংবার ফেলে দিয়ে থাকেন। কারণ, কণ্ঠনালীতে সেগুলোর হালকা অংশ অবশ্যই পৌছে থাকে। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)
রোযা ভঙ্গের কারণ, রোযার মাকরূহ, রোযা রাখার ওযর |
৪. চিনি ইত্যাদি, এমন জিনিষ, যা মুখে রাখলে গলে যায়, মুখে রাখলো আর থুুথু গিলে ফেললো এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে গেল। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)
৫. দাঁতগুলোর মধ্যভাগে কোন জিনিষ ছোলা বুটের সমান কিংবা তদপেক্ষা বেশি ছিল। তা খেয়ে ফেললো। কিংবা কম ছিলো; কিন্তু মুখ থেকে বের করে পুনরায় খেয়ে ফেললো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে।(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)
৬. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে তা কণ্ঠনালীর নিচে নেমে গেলো। আর রক্ত থুুথু অপেক্ষা বেশি কিংবা সমান অথবা কম ছিলো, কিন্তু সেটার স্বাদ কণ্ঠে অনুভুত হলো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং যদি কম ছিলো আর স্বাদও কণ্ঠে
অনুভুত হয়নি, তাহলে এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৮)
৭. রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও ‘ঢুস’ (*) নিলো, কিংবা নাকের ছিদ্র দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করালো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)
৮. কুল্লী করছিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানি কণ্ঠনালী বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কিংবা নাকে পানি দিলো; কিন্তু তা মগজে পৌঁছে গেলো। তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু যদি রোযাদার হবার কথা ভুলে গিয়ে থাকে, তবে রোযা ভাঙ্গবে না। যদিও তা ইচ্ছাকৃত হয়। অনুরূপভাবে রোযাদারের দিকে কেউ কোন কিছু নিক্ষেপ করলো, আর তা তার কণ্ঠে পৌঁছে গেলো। তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আল জাওয়াতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৮)
৯. ঘুমন্ত অবস্থায় পানি পান করলে, কিছু খেয়ে ফেললো, অথবা মুখ খোলা ছিলো; পানির ফোঁটা কিংবা বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি কণ্ঠে চলে গেলো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আল-জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৮)
১০. অন্য কারো থুুথু গিলে ফেললো। কিংবা নিজেরই থুু হাতে নেয়ার পর গিলে ফেললো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আমলগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১১. যতক্ষণ পর্যন্ত থুুথু কিংবা কফ মুখের ভিতর মওজুদ থাকে। তা গিলে ফেললে রোযা ভঙ্গ হয় না। বারংবার থুু থু ফেলতে থাকা জরুরী নয়।
১২. মুখে রঙ্গিন সুতা ইত্যাদি রাখার ফলে থুুথু রঙ্গিন হয়ে গেলো। তারপর ওই রঙ্গিন থুথুু গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৩. চোখের পানি মুখের ভিতর চলে গেলে আর সেটা গিলে ফেললেন। যদি এক/দুই ফোটা হয় তবে রোযা ভাঙ্গবে না। আর যদি বেশি হয়। যারফলে সেটার লবণাক্ততা মুখে অনুভুত হয়। তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। ঘামেরও একই বিধান।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৪. মলদ্বার বের হয়ে গেলো। এমতাবস্থায় বিধান হচ্ছে, তখন খুব ভাল করে কোন কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তা মুছে ফেলার পর দাঁড়াবে যাতে সিক্ততা বাকী না থাকে। আর যদি কিছু পানি অবশিষ্ট ছিলো, আর দাঁড়িয়ে গেলো, যার কারণে পানি ভিতরে চলে গেলো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। এ কারণে সম্মানিত ফকীহগণ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِمْ বলেন, “রোযাদার পানি ব্যবহারে সময় নিবে না।’ (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)
রোযা পালনকালে বমি হলে!
কখনো যদি রোযার সময় বমি হয়, তখন লোকেরা চিন্তিত হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ মনে করে যে, রোযা পালন কালে এমনিতে নিজে নিজে বমি হয়ে গেলেও রোযা ভেঙ্গে যায়। অথচ তেমন নয়। যেমন সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, হুযুর পূরনুর হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর মহান বাণী, “যার মাহে রমযানে আপনা আপনি বমি এসে যায়, তার রোযা ভাঙ্গে না। আর যে ব্যক্তি জেনে বুঝে, (স্বেচ্ছায়) বমি করে তার রোযা ভেঙ্গে যায়।” (কানযুল উম্মাল, খন্ড-৮ম, পৃ-২৩০, হাদীস নং-২৩৮১৪) অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, “যার আপনা আপনি বমি এসেছে তার উপর কাযা নেই। আর যে জেনে বুঝে বমি করেছে সে কাযা করবে।” (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭৩, হাদীস নং-৭২০)
বমি সম্পর্কে সাতটা নিয়মাবলী
১. রোযা অবস্থায় যদি নিজে নিজে কয়েকবার বমি এসে যায়। (চাই বালতি ভরে হোক)- এর কারণে রোযা ভাঙ্গে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
২. যদি রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় (জেনে বুঝে) বমি করলো, আর যদি তা মুখ ভর্তি করে আসে, (মুখ ভর্তির সংজ্ঞা সামনে আসছে), তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি হওয়ার ক্ষেত্রে ঐ সময় রোযা ভেঙ্গে যাবে যখন বমির সাথে খানা অথবা পানি বা হলুদ ধরনের তিক্ত ঝাঁঝালো পানি অথবা রক্ত আসে।
৪. যদি বমিতে শুধু কফ বের হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)
৫. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলো; কিন্তু সামান্য বমি আসলো, মুখ ভর্তি হয়ে আসেনি, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
৬. মুখভর্তি অপেক্ষা কম বমি হলে মুখ থেকে ফিরে গেলো। কিংবা নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়ও রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
৭. বিনা ইচ্ছায় মুখভর্তি বমি হয়ে গেলো রোযা ভাঙ্গবে না। অবশ্য, যদি তা থেকে একটা বুটের সমানও গিলে ফেলা হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এক বুটের পরিমাণের চেয়ে কম হলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-২য়, পৃ-৩৯২)
মুখভর্তি বমির সংজ্ঞা
মুখভর্তি বমির অর্থ হচ্ছে- সেটা অনায়াসে চলে আসে, যা চেপে রাখা যায় না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)
অযুবস্থায় বমির পাঁচটি শরয়ী বিধান
১. ওযু অবস্থায় (জেনে বুঝে করুক কিংবা নিজে নিজে হয়ে যাক উভয় অবস্থায়) যদি মুখভর্তি বমি আসে, আর তাতে খাদ্য, পানীয় কিংবা হলদে বর্ণের তিক্ত পানি আসে তবে ওযু ভেঙ্গে যাবে। (বাহারে শরীআত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)
২. যদি মুখভর্তি কফ-বমি হয, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। (বাহারে শরীআত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)
৩. প্রবাহমান রক্ত বমি হলে ওযু ভেঙ্গে যাবে।
৪. প্রবাহমান রক্তবমি তখনই ওযু ভেঙ্গে ফেলবে, যখন রক্ত থুুথু অপেক্ষা বেশি হয়। (রদ্দে মুহতার, খন্ড-১ম, পৃ-২৬৭) অর্থাৎ রক্তের কারণে বমি লাল হয়ে যায়। তখন রক্ত বেশি বলে গণ্য হবে। এমতাবস্থায় ওযু ভেঙ্গে যায়। আর যদি থুুথু বেশি হয় রক্ত কম হয়, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। রক্ত কম হওয়ার চিহ্ন হচ্ছে-পূর্ণ বমি, যাতে থু থু থাকে, তা হলদে বণের্র হবে।
৫. যদি বমিতে জমাট বাঁধা রক্ত বের হয়, আর তা পরিমাণে মুখভর্তি থেকে কম হয়, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)
প্রয়োজনীয় হিদায়াত
মুখভর্তি বমি, (কফ ব্যতীত) একেবারে প্রস্রাবের মতোই নাপাক। এর কোন ছিটা কাপড় কিংবা শরীরের উপর না পড়া চাই। এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন! আজকাল লোকেরা এ ক্ষেত্রে বড়ই অসতর্কতা দেখায়। কাপড়ে ছিটা পড়ুক তাতে কোন পরোয়াই করে না। আর মুখ ইত্যাদির উপর যেই নাপাক বমি লেগে যায় তাও নির্দ্বিধায় নিজের কাপড় দ্বারা মুছে নেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রত্যেক প্রকারের অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করুন!
ভুলবশতঃ পানাহার করলে রোযা ভাঙ্গে না
হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেন, “যে রোযাদার ভুলবশতঃ পানাহার করেছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ, তাকে আল্লাহ তাআলা পানাহার করিয়েছে। (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৩৬, হাদীস নং-১৯৩৩)
রোযা ভঙ্গ হয় না এমন জিনিসের ব্যাপারে ২১ নিয়মাবলী
১. ভুলবশতঃ আহার করলে, পান করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভাঙ্গে না, চাই ওই রোযা ফরয হোক কিংবা নফল। (আদ-দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
২. কোন রোযাদারকে এসব কাজে করতে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি আপনি স্মরণ করিয়ে না দেন তবে গুনাহগার হবেন। হাঁ, যদি রোযাদার খুবই দুর্বল হয়, কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিলে পানাহার ছেড়ে দেবে, যার ফলে তার দূর্বলতা এতোই বেড়ে যাবে যে, তার জন্য রোযা রাখা কঠিন হয়ে যাবে, আর পানাহার করে নিলে রোযাও ভালোমতে পূর্ণ করে নেবে এবং অন্যান্য ইবাদতও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, (যেহেতু সে ভুলে পানাহার করছে, এ কারণে তার রোযাও পূর্ণ হয়ে যাবে।) এমতাবস্থায়, স্মরণ করিয়ে না দেয়াই উত্তম। কোন কোন মাশাইখ কিরাম رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِمْ বলেন, “যুবককে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর বৃদ্ধকে দেখলে স্মরণ করিয়ে না দিলেও ক্ষতি নেই।” কারণ, যুবক বেশিরভাগই শক্তিশালী হয়ে থাকে। আর বুড়ো হয় বেশিরভাগ দুর্বল। সুতরাং বিধান হচ্ছে এ যে, যৌবন ও বার্ধক্যের কোন কথা এখানে নেই, বরং সক্ষম হওয়া ও দুর্বলতাই এখানে বিবেচ্য। অতএব যুবকও যদি এ পরিমাণ দূর্বল হয়,তবে স্মরণ করিয়ে না দেয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। আর বয়স্ক অথচ যদি শক্তিশালী হয় তবে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
৩. রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও যদি মাছি কিংবা ধুলিবালি কিংবা ধোঁয়া কণ্ঠনালী দিয়ে ভিতরে চলে যায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয় না, চাই ধুলি আটার হোক, যা চাক্কি পেষণ কিংবা আটা মেশিনে নেয়ার সময় উড়ে থাকে, চাই ফসলের ধুলি হোক, চাই বাতাসে মাটি উড়ে আসুক, কিংবা পশুর খুর ও পা থেকে আসুক। (আদ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৬৬)
৪. অনুরূপভাবে, বাস কিংবা গাড়ির ধোঁয়া অথবা সেগুলোর কারণে ধুলি ওড়ে কণ্ঠনালীতে পৌঁছে, যদিও রোযাদার হবার কথা স্মরণ ছিলো, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।
৫. যদি এমন হয় যে, বাতি জ্বলছে, আর সেটার ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করেছে, তবু রোযা ভাঙ্গবে না। হাঁ, যদি লোবান কিংবা আগর বাতি জ্বলতে থাকে আর রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও মুখ সেটার নিকটে নিয়ে গিয়ে নাক দ্বারা ধোঁয়া টানে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৬)
৬. শিঙ্গা লাগালো (*) কিংবা তেল অথবা সুরমা লাগালো, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না; যদিও তেল কিংবা সুরমার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভুত হয়, এমনকি যদি থুথুুর মধ্যে সুরমার রঙও দেখা যায়, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না। (আল-জাওহারাতুন্ নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৯)
* এটা ব্যথার চিকিৎসার একটা বিশেষ পদ্ধতি, যাতে ছিদ্র শিং ব্যথাগ্রস্ত স্থানে রেখে মুখ দিয়ে শরীরের দুষিত রক্ত টেনে বের করা হয়।
৭. গোসল করলে পানির শীতলতা, ঠান্ডা ভিতরে অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২৩০)
৮. কুলি করে পানি ফেলে দিলো। শুধু কিছুটা আর্দ্রতা মুখে অবশিষ্ট রয়ে গেলো, থুথুুর সাথে তা গিলে ফেলল, রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
৯. ঔষধ দাঁতে কাটলো, কণ্ঠনালীতে সেটার স্বাদ অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১০. কানে পানি ঢুকে গেলে, রোযা ভঙ্গ হয় না, বরং খোদ্ পানি ঢাললেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১১. খড়কুটা দ্বারা কান চুলকালো, ফলে ওই খড়কুটার ময়লা লেগে গেলো, আর ওই খড়কুটাটি পুনরায় কানে দিলো। সে কয়েকবার এমন করলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১২. দাঁত কিংবা মুখে হালকা এমন কোন জিনিষ অজানাবশতঃ রয়ে গেলো, যা থুথুর সাথে নিজে নিজেই নিচে নেমে যায়। বাস্তবেও তা নেমে গেছে। তবুও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১৩. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে কণ্ঠনালী পর্যন্ত গেলে, কিন্তু কণ্ঠনালী অতিক্রম করে নিচে নামেনি। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গেনি। (ফতহুল কদীর, খন্ড-২য়, পৃ-২৫৭)
১৪. মাছি কণ্ঠনালীতে চলে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৫. ভুল করে খাবার খাচ্ছিলো। মনে হতেই লোকমা ফেলে দিলে কিংবা পানি পান করছিলো, স্মরণ হতেই মুখের পানি ফেলে দিলো। তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি মুখের ভিতরের লোকমা কিংবা পানি স্মরণ হওয়া সত্ত্বেও গিলে ফেলে
তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৬. সুবহে সাদিকের পূর্বে আহার কিংবা পান করছিলো, আর ভোর হতেই (অর্থাৎ সাহারীর সময়সীমা শেষ হতেই) মুখের ভিতরের সবকিছু ফেলে দিল, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না, আর যদি গিলে ফেলে তবে ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৭. গীবত করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬২) যদিও গীবত জঘন্য কবীরা গুনাহ্। কুরআন মজীদে গীবত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতোই।’ আর হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘গীবত যেনা থেকেও জঘন্যতর।’ (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩১, হাদীস নং-২৬) অবশ্য, গীবতের কারণে রোযার নূরানিয়্যাত শেষ হয়ে যায়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-৬১১)
১৮. ‘জানাবত’ (অর্থাৎ গোসল ফরয হবার) অবস্থায় কারো ভোর হলো, বরং গোটা দিনই ‘জুনুব’ (অর্থাৎ গোসল বিহীন) রয়ে গেলো, তবুও রোযা ভাঙ্গেনি। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭২) কিন্তু এত দীর্ঘক্ষণ যাবত ইচ্ছাকৃতভাবে
(অর্থাৎ জেনে বুঝে) গোসল না করা, যাতে নামায কাযা হয়ে যায়, গুনাহ ও হারাম। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ঘরে ‘জুনুবী’ থাকে সে ঘরে রহমতের ফিরিশতা আসে না।” (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৬)
১৯. সরিষা কিংবা সরিষার সমান কোন জিনিষ চিবালে, আর থুথুর সাথে কণ্ঠনালী দিয়ে নিচে নেমে গেলে, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি সেটার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভূত হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (ফতহুল কাদীর, খন্ড-২য়, পৃ- ২৫৯)
২০. থুথুু কিংবা কফ মুখে আসলে সেটা গিলে ফেললো, রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)
২১. অনুরূপভাবে নাকে শ্লেষ্মা জমা হয়ে রইলো। তা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে টেনে গিলে ফেললেও রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)
রোযার মাকরূহ সমূহ
এখন রোযার মাকরূহ সমূহ বর্ণনা করা হচ্ছে, যে সব কাজ করলে রোযা বিশুদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু সেটার নূরানিয়্যাত চলে যায়। প্রথমে তিনটি হাদীস শরীফ দেখুন, তারপর ফিকহ শাস্ত্রের বিধানাবলী আরয করা হবে।
১. হযরত সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, তাজদারে মদীনা, হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) খারাপ কথা ও খারাপ কাজ পরিহার করেনি, তার পানাহার ছেড়ে দেওয়া আল্লাহ তাআলার কাছে কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬২৮, হাদীস নং-১৯০৩)
২. হযরত সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, “তাজেদারে মদীনা সুরুরে কলবো সীনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ ফরমান, “রোযা হচ্ছে ঢাল, যতক্ষণ না সেটাকে ছিদ্র করে না দাও।” আরয করা হলে, “কোন জিনিষ দিয়ে ছিদ্র করা হয়?” ইরশাদ ফরমালেন, “মিথ্যা কিংবা গীবত দ্বারা।” (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-২য়, পৃ-৯৪, হাদীস নং-০৩)
৩. হযরত সায়্যিদুনা আমের ইবনে রবীআহ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُمْا থেকে বর্ণিত, “আমি অনেকবার সরকারে ওয়ালা তাবার হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে রোযা পালনকালে মিসওয়াক করতে দেখেছি।” (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭৬, হাদীস নং- ৭২৫)
রোযার মাকরূহ সমূহের ১২টি নিয়মাবলী
১. মিথ্যা, চোগলখোরী, গীবত, কুদৃষ্টি, গালিগালাজ করা, শরীয়তের অনুমতি ব্যতীত কারো মনে কষ্ট দেয়া ও দাড়ি মুন্ডানো ইত্যাদি কাজ এমনিতেতো অবৈধ ও হারাম বা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, রোযায় আরো বেশি হারাম। সেগুলোর কারণে রোযা মাকরূহ হয়ে যায়।
২. রোযাদারের জন্য কোন জিনিষকে বিনা কারণে স্বাদ গ্রহণ করা ও চিবুনো মাকরূহ। স্বাদ গ্রহণের জন্য ওযর হচ্ছে, যেমন কোন নারীর স্বামী বদ-মেযাজী তরকারী ইত্যাদিতে লবণ কমবেশি হলে রাগ করবে। এ কারণে স্বাদ গ্রহণে ক্ষতি
নেই। চিবুনোর জন্য ওযর হচ্ছে, এতোই ছোট শিশু আছে যে রুটি চিবুতে পারে না; এমন কোন নরম খাদ্যও নেই যা তাকে খাওয়ানো যাবে; না আছে কোন ঋতুস্রাব (**) কিংবা নিফাস সম্পন্না নারী অথবা এমন কেউ নেই, যে তা চিবিয়ে দেবে, তাহলে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য রুটি ইত্যাদি চিবুনো মাকরূহ নয়। (আদ দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ- ৩৯৫) কিন্তু এ ক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বণ করবে। যদি কণ্ঠনালী দিয়ে কিছু নিচে নেমে যায় তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
** ঋতুস্রাব ও প্রসবোত্তরকালীন রক্তক্ষরণকালে (হায়য ও নিফাসসম্পন্না) নারীর জন্য রোযা, নামায ও তিলাওয়াত না-জায়িয ও গুনাহ্। নামায তার জন্য মাফ; কিন্তু পাক হয়ে যাবার পর রোযার কাযা আদায় করতে হবে।
** ঋতুস্রাব ও প্রসবোত্তরকালীন রক্তক্ষরণকালে (হায়য ও নিফাসসম্পন্না) নারীর জন্য রোযা, নামায ও তিলাওয়াত না-জায়িয ও গুনাহ্। নামায তার জন্য মাফ; কিন্তু পাক হয়ে যাবার পর রোযার কাযা আদায় করতে হবে।
স্বাদ গ্রহণ কাকে বলে?
স্বাদ গ্রহণের অর্থও তা নয়, যা আজকাল সাধারণ পরিভাষায় বলা হয়। অর্থাৎ আজকাল বলতে শোনা যায়, ‘কোন জিনিষের স্বাদ বুঝার জন্য তা থেকে কিছুটা খেয়ে নেয়া যাবে।’ এমন করা হলে মাকরূহ কিভাবে? বরং রোযাই ভেঙ্গে যাবে; এবং কাফফারার শর্তাবলী পাওয়া গেলে কাফফারাও অপরিহার্য হয়ে যাবে। স্বাদ নেয়ার অর্থ হচ্ছে-শুধু জিহ্বায় রেখে স্বাদ বুঝে নেবেন। আর সাথে সাথে তা থুথুুর সাথে ফেলে দেবেন, তা থেকে যেন কণ্ঠনালী দিয়ে কিছু নিচে যেতে না পারে।
৩. যদি কোন জিনিষ কিনলো আর সেটার স্বাদ দেখা জরুরী। কারণ, স্বাদ না দেখলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। এমতাবস্থায় স্বাদ পরীক্ষা করতে ক্ষতি নেই, অন্যথায় মাকরূহ। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৫)
৪. স্ত্রীকে চুমু দেয়া ও আলিঙ্গন করা এবং স্পর্শ করা মাকরূহ নয়; অবশ্য যদি এ আশঙ্কা থাকে যে, বীর্যপাত হয়ে যাবে, কিংবা সহবাসে লিপ্ত হয়ে যাবে তাহলে করা যাবে না। আর দুধের বোঁটা ও জিহ্বা শোষণ করা রোযার মধ্যে নিঃশর্তভাবে
মাকরূহ। অনুরূপভাবে ‘মুবাশারাতে ফাহিশাহ (অর্থাৎ বিবস্ত্রাবস্থায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পর যৌনাঙ্গ লাগানো মাকরূহ)*। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৬)
* বিবাহ শাদীর নিয়্যত সম্পর্কিত বিষয় সমূহ জানার জন্য ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ, খন্ড-২৩, পৃ- ৩৮৫-৩৮৬ তে ৪১, ৪২ নম্বর মাসআলা অধ্যয়ন করুন।
৫. গোলাপ কিংবা মুশক ইত্যাদির ঘ্রাণ নেয়া, দাড়ি ও গোঁফে তেল লাগানো ও সুরমা লাগানো মাকরূহ নয়। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৭)
৬. রোযা রাখা অবস্থায় যে কোন ধরণের আতরের ঘ্রাণ নেয়া যেতে পারে। আর কাপড়েও ব্যবহার করা যাবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৭)
৭. রোযা পালনকালে মিসওয়াক করা মাকরূহ নয় বরং অন্যান্য দিনগুলোতে যেমন সুন্নত তেমনি রোযায়ও সুন্নত। মিসওয়াকও শুষ্ক হোক কিংবা ভেজা, যদিও পানি দ্বারা নরম করে নেয়া হয়, সূর্য পশ্চিম দিকে হেলার পূর্বে করুক কিংবা পরে করুক, কোন সময় বা কোন অবস্থাতেই মাকরূহ নয়। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
৮. বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, রোযাদারের জন্য দুপুরের পর মিসওয়াক করা মাকরূহ। এটা আমাদের হানাফী মাযহাবের মাসআলা বিরোধী কথা। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
৯. যদি মিসওয়াক চিবুলে আঁশ ছুটে যায়, স্বাদ অনুভূত হয়, এমন মিসওয়াক রোযা পালনকালে ব্যবহার করা উচিত নয়। (ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ্ সংশোধিত, খন্ড-১০, পৃ-৫১১) যদি মিসওয়াকের কোন আঁশ কিংবা কোন অংশ কণ্ঠনালীর নিচে নেমে যায়, তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১০. ওযু ও গোসল ব্যতীত ঠান্ডা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কুলি করা কিংবা নাকে পানি দেয়া অথবা ঠান্ডার খাতিরে গোসল করা বরং শরীরের উপর ভেজা কাপড় জড়ানো মাকরূহ নয়। অবশ্য পেরেশানীভাব প্রকাশের জন্য ভেজা কাপড় জড়ানো মাকরূহ, ইবাদত পালনে মনকে সঙ্কুচিত করা ভালো কথা নয়। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
১১. কোন কোন ইসলামী ভাই বারংবার থুথুু ফেলতে থাকে। হয়তো সে মনে করে যে, রোযা পালনকালে থুথুু গিলে ফেলা উচিত নয়। মূলতঃ এমন নয়। অবশ্য, মুখে থুথুু একত্রিত করে গিলে ফেলা-এটাতো রোযা ছাড়া অন্য সময়েও অপছন্দনীয় কাজ। আর রোযা পালনকালে মাকরূহ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১২৯)
১২. রমযানুল মুবারকের দিনগুলোতে এমন কোন কাজ করা জায়িয নয়, যার কারণে এমন দূর্বলতা এসে যায় যে, রোযা ভেঙ্গে গেছে এমন ধারণা জন্মে যায়। সুতরাং রুটি তৈরীকারীর উচিত হচ্ছে, দুপুর পর্যন্ত রুটি পাকাবে, তারপর বিশ্রাম নেবে। (দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০০)
এ বিধান রাজমিস্ত্রি, মজদুর ও অন্যান্য পরিশ্রমী লোকদের জন্যও। বেশি দূর্বলতার সম্ভাবনা হলে কাজের পরিমাণ কমিয়ে নিন, যাতে রোযা সম্পন্ন করতে পারেন।
রোযা না রাখার ওযরসমূহ
এখন ওইসব অপরাগতার কথা বর্ণনা করা হচ্ছে, যেগুলোর কারণে রমযানুল মুবারকে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, অপারগতার কারণে রোযা মাফ নয়। ওই অপারগতা দূরীভূত হয়ে যাবার পর সেটার কাযা রাখা ফরয। অবশ্য, এ কাযার কারণে গুনাহ্ হবে না। যেমন, ‘বাহারে শরীয়ত’ এ ‘দুররে মুখতার’ এর বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সফর, গর্ভাবস্থায়, সন্তানকে স্তনের দুধ পান করানো, রোগ, বার্ধক্য, প্রাণ-নাশের ভয়, জোর-যবরদস্তি, পাগল হয়ে যাওয়া ও জিহাদ এ সবই রোযা না রাখার ওযর। এসব ওযরের কারণে যদি কেউ রোযা না রাখে, তবে সে গুনাহগার নয়। যদি কেউ প্রাণে মেরে ফেলার কিংবা কোন অঙ্গ কেটে ফেলার অথবা মারাত্মকভাবে প্রহারের বাস্তবিক পক্ষেই হুমকি দিয়ে বলে, “রোযা ভেঙ্গে ফেল।” আর রোযাদারও জানে যে, একথা যে বলছে সে যা বলছে তাই করে ছাড়বে, এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গা কিংবা না রাখা গুনাহ্ নয়। ‘জোর-যবরদস্তি মানে এটাই।’ (দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)
সফরের সংজ্ঞা
সফরের মধ্যেও রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। সফরের পরিমাণও জেনে নিন! সায়্যিদী ও মুরশিদী ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরত মওলানা শাহ আহমদ রযা খান رحمة الله عليه এর গবেষণা অনুসারে শরীয়ত সম্মত সফরের পরিমাণ হচ্ছে- সাতান্ন মাইল তিন ফরলঙ্গ (অর্থাৎ প্রায় ৯২ কিলোমিটার)। যে কেউ এতটুকু দূরত্বে সফর করার উদ্দেশ্যে আপন শহর কিংবা গ্রামের বসতি থেকে দূরে যায়, সে তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসাফির। তার জন্য রোযা কাযা করার অনুমতি রয়েছে। আর নামাযেও কসর করবে। মুসাফির যদি রোযা রাখতে চায় তবে রাখতে পারবে; কিন্তু চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাযে কসর করা তার জন্য ওয়াজিব। কসর না করলে গুনাহগার হবে। অজ্ঞতাবশতঃ যদি পূর্ণ (চার) রাকআত পড়ে নেয়, তবে ওই নামাযকে পুনরায় পড়া ওয়াজিব। (ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ্ সংশোধিত, খন্ড-৮ম, পৃ-২৭০) অর্থাৎ জানা না থাকার কারণে আজ পর্যন্ত যতো নামাযই সফরে পূর্ণভাবে আদায় করেছে সেগুলোর হিসাব করে চার রাকআত ফরয কসরের নিয়্যতে দু দু রাকআত করে পুনরায় পড়তে হবে। হাঁ, মুসাফির মুকীম ইমামের পেছনে ফরয চার রাকআত পূর্ণ পড়তে হয়। সুন্নতসমূহ ও বিতরের নামায পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। কসর শুধু যোহর, আসর ও ইশার ফরয রাকআত গুলোতেই করতে হয়। অর্থাৎ এগুলোতে চার ফরযের স্থানে দু’ রাকআত সম্পন্ন করা হবে। অবশিষ্ট সুন্নত সমুহ এবং বিতরের রাকআতগুলো পুরোপুরিই পড়তে হবে। অন্য কোন শহর কিংবা গ্রাম ইত্যাদিতে পৌঁছার পর যতক্ষণ ১৫ দিন থেকে কম সময়ের জন্য অবস্থান করার নিয়্যত করে নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ‘মুসাফির’ই বলা হবে এবং তার জন্য মুসাফিরের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে। আর যদি মুসাফির সেখানে পৌঁছে ১৫ দিন কিংবা আরো বেশি সময় অবস্থান করার নিয়্যত করে নেয়, তাহলে এখন মুসাফিরের বিধানাবলী শেষ হয়ে যাবে এবং তাকে ‘মুকীম’ বলা হবে। এখন তার রোযাও রাখতে হবে, নামাযেও কসর করবে না।
সামান্য অসুস্থতা কোন অপারগতা নয়
যদি কোন ধরনের অসুখ হয় এবং যদি এ অবস্থায় তার রোযা রাখলে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার বা দেরীতে সুস্থতা লাভ করার প্রবল ধারণা হয় তবে তার জন্য রোযা না রেখে পরবর্তীতে তা কাজা করার অনুমতি রয়েছে। (এর বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে) কিন্তু আজকাল দেখা যায় মানুষ সামান্য সর্দি, জ্বর, মাথা ব্যাথার কারণে রোযা ছেড়ে দেয় অথবা আল্লাহরই পানাহ রোযা রেখে ভেঙ্গে ফেলে, এ রকম কখনো না হওয়া চাই, যদি কেউ কোন বিশুদ্ধ শরয়ী কারণ ছাড়া রোযা রাখা ছেড়ে দেয়, যদি ও সে পরবর্তীতে সারাজীবনও রোযা রাখে তবুও ঐ একটি রোযার ফযীলত কখনো পাবে না। যেহেতু ‘রোযা না রাখার ওযরসমূহ’ এর বিস্তারিত বর্ণনা সামনে করা হবে, সেহেতু তিনটি বরকতময় হাদীস বর্ণনা করা হচ্ছে:
সফরে ইচ্ছা হলে, রোযা রাখো, নতুবা ছেড়ে দাও
(১) উম্মুল মুমিনীন হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দীকা رضى الله عنها বর্ণনা করেছেন, “হযরত সায়্যিদুনা হামযা ইবনে আমর আসলামী رضى الله عنه বেশি রোযা রাখতেন। তিনি মদীনার তাজেদার, হযরত মুহাম্মদ ﷺ কে জিজ্ঞাসা করে আরয করলেন, “আমি কি সফরে রোযা রাখবো?” হুযুর ﷺ ইরশাদ করলেন, “ইচ্ছা হলে রাখো, আর ইচ্ছা না হলে রেখোনা।” (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৪০, হাদীস নং-১৯৪৩)
(২) হযরত সায়্যিদুনা আবু সাঈদ খুদরী رضى الله عنه বলেন, “১৬ রমযানুল মুবারক সারওয়ারে কাইনাত হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে আমরা জিহাদে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রোযা রেখেছিলেন, আর কেউ কেউ রাখেননি। তখন রোযাদারগণ যারা রোযা রাখেনি তাদের প্রতি দোষারোপ করেনি এবং যারা রোযাদার না তারাও রোযাদারদের বিরূদ্ধে দোষারূপ করেন নি, একে অপরের বিরুধিতা করেন নি।” (মুসলিম শরীফ, খন্ড-১ম, পৃ-৫৬৪, হাদীস নং-১১১৬)
(৩) হযরত সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালিক কাবী رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, মদীনার তাজদার হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’আলা মুসাফির থেকে অর্ধেক নামায ক্ষমা করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামায দুরাকআত পড়বে।) আর মুসাফির ও স্তন্যদাত্রী এবং গর্ভবতীর রোযা ক্ষমা করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ: তখন রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। পরবর্তীতে সে পরিমাণ রোযা কাযা আদায় করবে।) (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭০, হাদীস-১৭৫) (কিন্তু ওই অপারগতা শেষ হয়ে যাবার পর প্রতিটি রোযার পরিবর্তে একটি করে রোযা কাযা করতে হবে।)
--------
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত রযমান মাসের বিস্তারিত মাসাইল সম্পর্কিত “রমযানের ফযিলত” নামক কিতাবের ১৪৭-১৫৮ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। কিতাবটি নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।
যারা মোবাইলে (পিডিএফ) কিতাবটি পড়তে চান তারা ফ্রি ডাউনলোড করুন
মাদানী চ্যানেল দেখতে থাকুন