বিভাগ সমূহ

রবিবার, ৩ মে, ২০২০

রাগের চিকিৎসা :রাগ দমন করার ফযীলত (প্রথম অংশ)


শয়তানের তিনটি ফাঁদ

হযরত সায়্যিদুনা ফকীহ আবুল লাইছ সমরকন্দী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ “তাম্বীহুল গাফেলীন” নামক কিতাবে বর্ণনা করেন, হযরত সায়্যিদুনা ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন, একদা বনী ঈসরাইলের একজন বুযুর্গ কোথাও তাশরীফ নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটি স্থানে হঠাৎ পাথরের একটি বিশাল খন্ড উপরের দিক হতে মাথার নিকটে এসে পৌঁছল। তৎক্ষণাৎ তিনি আল্লাহ তাআলার যিকির আরম্ভ করে দিলেন। ফলে পাথরের খন্ডটি দূরে সরে গেল। অতঃপর ভয়ানক বাঘ ও হিংস্র জন্তু সমূহ প্রকাশ হতে লাগল।কিন্তু বুযুর্গ ব্যক্তিটি رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ ভীত না হয়ে আল্লাহ তা’আলার যিকিরে রত রইলেন। যখন ঐ বুযুর্গ নামাযে মশগুল হয়ে গেলেন তখন একটি সাপ এসে পায়ের সাথে জড়িয়ে গেল। এমনকি সাপটি পায়ের দিক হতে পেচাতে পেচাতে মাথা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। যখন ঐ বুযুর্গ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ সিজদা করার ইচ্ছা করতেন তখন ঐ সাপ চেহারার সাথে পেচিয়ে যেত। সিজদার জন্য মাথা ঝুঁকাতেই সে সাপ সিজদার জায়গায় (ঐ বুযুর্গকে) ভক্ষণ করার জন্য মুখ খুলে দিত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ঐ বুযুর্গ সে সাপকে সরিয়ে দিয়ে সিজদা করতে সফল হয়ে যেতেন। যখন নামায শেষ হল শয়তান প্রকাশ্যভাবে সামনে এসে উপস্থিত হল এবং বলতে লাগল, এই সমস্ত কাজগুলো আমিই করেছিলাম। আপনি খুবই সাহসী। আমি আপনার আচরণে খুবই প্রভাবিত হয়েছি। সুতরাং আমি এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে আর কখনো ধোঁকা দেব না। দয়া করে আপনি আমার সাথে বন্ধুত্ব করে নিন। ঐ বনী ইসরাঈলী বুযুর্গ শয়তানের এ আক্রমনকেও প্রতিহত করলেন এবং বললেন, তুই আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলি কিন্তু اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَزَّوَجَلّ আমি ভয় পায়নি। আর আমি কখনো তোর সাথে বন্ধুত্ব করবো না। শয়তান বলল, ঠিক আছে। অন্তত আপনি এটা জেনে নিন, আপনার ইন্তিকালের পর আপনার পরিবার বর্গের অবস্থা কেমন হবে? ঐ বুযুর্গ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বললেন: তোর থেকে জানার আমার কোনো প্রয়োজন নেই, শয়তান বলল, তাহলে এটা জেনে নিন, আমি লোকদের কিভাবে ধোকা দিয়ে থাকি। তিনি বললেন, হ্যাঁ এটা বলে দাও। শয়তান বলল,আমার তিন ধরনের ফাঁদ আছে।

(১) কৃপণতা, (২) রাগ, (৩) নেশা। নিজের এ তিনটি ফাঁদের বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে সে বলল, যখন আমি কাউকে কৃপণতার ফাঁদে ফেলি, তখন তাকে সম্পদের পেরেশানীতে ব্যস্ত করে রাখি এবং তার মাঝে এমন মন মানসিকতা তৈরী করি যে, তার কাছে যা সম্পদ আছে এটা তার প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। (এভাবে সে কৃপণতার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে) এবং যা খরচ করা তার জন্য ওয়াজিব হয়ে পড়েছে তা করা থেকেও বিরত থাকে এবং অন্য লোকদের সম্পদের প্রতি লালসা করতে থাকে। (এভাবে সে সম্পদের লোভে ফেঁসে যায় আর নেকী থেকে দূরে সরে যায় ও গুনাহের সাগরে ডুবে যায়)। যখন কাউকে রাগের ফাঁদে আটকাতে সফল হয়ে যাই তখন যেভাবে ছোট শিশুরা বলকে ছোড়াছুড়ি করে খেলায় ও আনন্দে মেতে উঠে আমিও ঐরূপ রাগী ব্যক্তিকে এভাবে শয়তানের জামায়াতে (দলে) নিক্ষেপ করি। রাগী ব্যক্তি ইলম ও আমলের দিক দিয়ে যতই উচ্চ  মর্যাদার আসনে আসীন হোক না কেন অথবা দুআ করে কোন মৃতকে জীবিত পর্যন্ত করার ক্ষমতা রাখুক না কেন আমি তার থেকে নিরাশ হই না। আমি অপেক্ষায় থাকি কখনো না কখনো তার রাগ আসবে আর সে রাগকে নিজের আয়ত্বে রাখতে না পেরে মুখ দিয়ে এমন কথা উচ্চারণ করে ফেলবে যার দ্বারা তার আখিরাত ধ্বংস হয়ে যাবে। বাকী রইলো নেশা। আমার এ ফাঁদে শিকার অর্থাৎ নেশাখোর একে তো ছাগলের কান ধরে টানার মত যে গুনাহে ইচ্ছা সে গুনাহে শামিল করি। এভাবে শয়তান এটা বলে দিয়েছে, যে ব্যক্তি রাগী সে শয়তানের হাতে তেমনি যেন বাচ্চার হাতে বল, এ কারণে রাগী ব্যক্তিকে ধৈর্যধারণ করা উচিত যেন শয়তানের হাতে গ্রেফতার হয়ে নিজের আমল নষ্ট না করে। (তাম্বীহুল গাফিলিন, পৃ-১১০)

অধিকাংশ লোক রাগের কারণে জাহান্নামে যাবে

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! এ বুযুর্গ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ এর সাথে কথাবার্তায় শয়তান একথাও বলে দিয়েছে যে, রাগী ব্যক্তি শয়তানের হাতে তেমনি যেভাবে বাচ্চার হাতে  খেলার বল। সুতরাং রাগের চিকিৎসা করা জরুরী। এমন  যেন না হয় শয়তান রাগ দ্বারা সমস্ত আমল নষ্ট করে ফেলে। “কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত” এর মধ্যে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গাজালী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বর্ণনা করেন, রাগের চিকিৎসার জন্য কষ্ট, পরিশ্রম করা ও ধৈর্যধারণ করা ফরয। কেননা অধিকাংশ লোক রাগের কারণে জাহান্নামে যাবে। (কিমিয়ায়ে সায়াদাত, খন্ড-২, পৃ-৬০১)
হযরত সায়্যিদুনা হাসান বসরী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ ফরমান: ‘হে মানব রাগের বশবতী হয়ে তোমরা যেভাবে উত্তেজিত হও, তোমাদের এ উত্তেজনা তোমাদেরকে যাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ না করে।’ (ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, খন্ড-৩, পৃ-২০৫)

صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد

রাগের সংজ্ঞা

প্রখ্যাত মুফাসসির, হাকিমুল উম্মত, হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন: ‘রাগ নফসের ঐ উত্তেজনার নাম যা অন্যদের থেকে প্রতিশোধ নেয়া অথবা সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য উৎসাহ যোগায়।’(মিরাতুল মানাজীহ, খন্ড-৬, পৃ-৬৫৫)

রাগের দ্বারা সৃষ্ট ১৬টি অপকর্মের বর্ণনা

রাগের কারণে অনেক ধরনের গুনাহ জন্ম নিয়ে থাকে, যা আখিরাতকে নষ্ট করে দেয়। যেমন :- (১) হিংসা, (২) গীবত, (৩) চোগলী, (৪) ঘৃণা, (৫) সম্পর্কছিন্ন, (৬) মিথ্যা, (৭) সম্মান নষ্ট করা, (৮) অপরকে ছোট জানা, (৯) গালিগালাজ, (১০) অহংকার, (১১) বিনা কারণে মারামারি, (১২) ঠাট্টা তামাশা, (১৩) নির্দয় হওয়া, (১৪) চক্ষু লজ্জা উঠে যাওয়া, (১৫) কারো ক্ষতিতে সন্তুষ্ট থাকা, (১৬) অকৃতজ্ঞ হওয়া ইত্যাদি। আসলে যার উপর রাগ আসে যদি তার ক্ষতি হয় তাতে রাগী ব্যক্তি খুশি অনুভব করে। যদি তার উপর কোন বিপদ আসে তবে রাগী ব্যক্তি সন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং তার সমস্ত উপকারের কথা ভুলে যায় আর তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, অনেকের রাগ অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং বছরের পর বছর মনের মধ্যে জমিয়ে রাখে। ঐ রাগের বশবর্তীতে কারো মৃত্যু অথবা বিবাহের অনুষ্ঠান প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করে না। অনেক লোক প্রকাশ্যভাবে যদিও নেককার হয় তারপরও রাগকে মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে লালন পালন করতে থাকে, তার প্রকাশ এভাবে হয় যে, যার উপর সে রাগ করেছে তাকে যে ধারাবাহিকভাবে সহযোগীতা করে আসতেছিল তা বন্ধ করে দেয়। এখন তার প্রতি সদাচরণ করে না, সহানুভূতি দেখায় না, এমনকি সে যদি কোন ইজতিমায়ী যিকির ও নাত মাহফিল ইত্যাদির আয়োজন করে আল্লার পানাহ শুধুমাত্র নিজের অসন্তুষ্টি ও রাগের কারণে এরূপ বরকতময় অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কতিপয় আত্মীয়-স্বজন এমনও রয়েছে যে, তাদের সাথে লক্ষ বারও সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার করা হলেও ভাল আচরণের প্রতি কোন দৃষ্টিপাত করে না। তারপরেও আমাদের নিরাশ হওয়া উচিত নয়। “জামে সগীরের” মধ্যে রয়েছে َصِلْ مَنْ قَطَعَک অর্থাৎ যে ‘তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ।’ (জামে সগীর লিস সুয়ুতী, পৃ-৩০৯, হাদীস নং-৫০০৪)

মওলানা রুমী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বলেন,
তু বরায়ে ওয়াছল করদন আমদী
নে বরায়ে ফছল করদন আমদী
অর্থাৎ- তুমি সম্পর্ক রক্ষা করতে এসেছ। সম্পর্ক বিনষ্ট করতে নয়।

صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد


রাগ দমন করার চিকিৎসা

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! বাস্তবে রাগের প্রতিকার এইভাবে হতে পারে যে, সকলকে প্রথমে রাগ দমন ও ক্ষমা প্রদর্শনের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। যখন রাগ আসবে, তখন রাগ দমনের ফযীলতের প্রতি দৃষ্টি রেখে তা দমন করার চেষ্টা করবেন। বোখারী শরীফের মধ্যে আছে, এক ব্যক্তি রাসুলে করীম صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দরবারে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم! আমাকে অসিয়ত করুন। ইরশাদ করলেন, “রাগ করিওনা”। ঐ ব্যক্তি বারবার আরজ করল, আর উত্তর পেল, “রাগ করিওনা”। (ছহীহ বোখারী, খন্ড-৪র্থ, পৃষ্ঠা-১৩১, হাদীস-৬১১৬)

জান্নাতের সুসংবাদ

হযরত সায়্যিদুনা আবু দারদা رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ বলেন, আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم আমাকে এমন কিছু আমলের নির্দেশ দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। মদীনার তাজেদার, হুযুর নবী করীম صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: َلاَ تَغْضَبْ وَلَك الْجَنَّةُ “অর্থাৎ “রাগ করিওনা” তবে তোমার জন্য জান্নাত রয়েছে।” (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৩৪, হাদীস-১২৯৯)


শক্তিশালী বীর কে?

বোখারী শরীফের মধ্যে রয়েছে, যে বীর অপরকে কুস্তিতে পরাজিত করে, সে শক্তিশালী নয় বরং শক্তিশালী হচ্ছে সেই, যে রাগের সময় নিজেকে দমন করে রাখে। (সহীহ বুখারী, খন্ড-৪, পৃ-১৩০, হাদীস-৬১১৪)


রাগ দমনের ফযীলত

‘কানযুল উম্মাল’ নামক কিতাবে রয়েছে, নবী করীম, রউফুর রাহিম, হুযুর পুরনূর صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “যে (ব্যক্তি) রাগকে প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দমন করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ ঐ (ব্যক্তির) অন্তরকে নিজের সন্তুষ্টি দিয়ে পরিপূর্ণ করবেন।” (কানযুল ওম্মাল, খন্ড-৩য়, পৃষ্ঠা-১৬৩, হাদীস-৭১৬০) যখন কোন কথা শুনে রাগ আসে তখন বুযুর্গানে দ্বীন رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِمْ এর রাগ দমনের পদ্ধতি এবং নিম্নে বর্ণিত তাঁদের ঘটনা সমূহ বারবার স্মরণ করুন।

সাতটি ঈমান তাজাকারী ঘটনা

ঘটনা-১. “কিমিয়ায়ে সা’আদাত” এর মধ্যে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত সায়্যিদুনা ইমাম মুহাম্মদ গাজালী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বর্ণনা করেন:‘ এক ব্যক্তি হযরত আমীরুল  মু'মীনিন সায়্যিদুনা উমর বিন আবদুল আযীয رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ এর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে তিনি মাথা নিচু করে নিলেন এবং বললেন, হে লোক! তুমি কি আশা করছ যে, আমার রাগ আসুক এবং শয়তান আমাকে অহংকার ও ক্ষমতার দাপটে লিপ্ত করুক। আর আমি তোমাদের উপর জুলুম করি এবং তোমরা কিয়ামতের দিন আমার থেকে তার প্রতিশোধ নিবে? আমি তা কখনো হতে দিবনা। এই বলে তিনি চুপ হয়ে গেলেন।’ (কিমিয়ায়ে সা’আদাত, খন্ড-২, পৃ-৫৯৭)

ঘটনা-২. কোন ব্যক্তি হযরত সায়্যিদুনা সালমান ফারসী رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ কে গালি দিল। তিনি উত্তরে বলেন, যদি কিয়ামত দিবসে আমার গুনাহের পাল্লা ভারী হয় তাহলে তুমি এখন আমাকে যা বলেছ আমি তার চেয়েও খারাপ। আর যদি আমার সৎকাজের পাল্লা ভারী হয়, তাহলে তোমার গালির আমি কোন পরোয়া করিনা। (এত্তেহাফুস্ সাদাত্তিল্ মুত্তাকীন, খন্ড-৯ম, পৃষ্ঠা-৪১৬)

ঘটনা-৩. কোন একজন ব্যক্তি হযরত সায়্যিদুনা শাইখ রবী ইবনে খাছিম رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে গালি দিয়েছে। তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমার গালি শুনেছেন। আমার এবং জান্নাতের মধ্যখানে একটি ঘাঁটি (বাঁধা)  রয়েছে। আমি উক্ত বাঁধাকে দূর করতে ব্যস্ত। যদি আমি আমার এ চেষ্টায় সফল হয়ে যায়, তাহলে আমি তোমার গালির কোন পরোয়া করিনা। আর যদি নিস্ফল হই, তাহলে তোমার এ গালি আমার জন্য যথেষ্ট নয়। (প্রাগুক্ত)

ঘটনা-৪. আমীরুল মু'মিনীন হযরত সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ কে কোন এক ব্যক্তি গালি দিলে, তিনি জবাবে বলেন, “আমার তো এ রকম (তোমার গালির মত) আরো অনেক দোষ ত্রুটি রয়েছে, যা আল্লাহ তাআলা তোমার থেকে গোপন রেখেছেন। (ইহইয়াউল উলুমিদ্দীন, খন্ড-৩য়, পৃষ্ঠা-২১২)

ঘটনা-৫. কোন একজন ব্যক্তি হযরত সায়্যিদুনা শা'বী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে গালি দিলে, তিনি বললেন, তুমি যদি সত্য বলে থাক, তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করুক। আর যদি মিথ্যা বলে থাক, তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাকে ক্ষমা করুক। (ইহইয়াউল উলুমিদ্দীন, খন্ড-৩য়, পৃষ্ঠা-২১২)

ঘটনা-৬. হযরত সায়্যিদুনা ফুযাইল বিন আয়ায رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে বলা হল: হুজুর! অমুক ব্যক্তি আপনাকে মন্দ বলেছে। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি শয়তান কে নারাজ করব। অতঃপর তিনি দুআ করলেন,  হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার দোষ ত্রুটি বর্ণনা করেছে, যদি তা বাস্তবে আমার মধ্যে থাকে, তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন এবং সংশোধনের ক্ষমতা দিন। আর যদি সে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে, তাহলে আপনি সে ব্যক্তিকে ক্ষমা করুন।

ঘটনা-৭: এক ব্যক্তি সায়্যিদুনা বকর বিন আবদুল্লাহ মুজনী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ কে সবার সামনে মন্দ বলে যাচ্ছে কিন্তু তিনি চুপ রইলেন। কোন একজন বলল, আপনি কোন প্রতিবাদ করছেন না কেন? তিনি বললেন: আমি তো তার কোন দোষ ক্রটি সম্পর্কে অবগত নই যে, তাকে মন্দ বলব। আর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কেনই বা গুনাহগার হব। سُبْحٰنَ اللهِ عَزَّوَجَل এ সকল পবিত্র আত্মার অধিকারী বুযুর্গরা কতই সহজ সরল পবিত্র মন-মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন। কতই সুন্দরভাবে রাগের চিকিৎসা করেছেন। তাঁদের খুব ভাল করে জানা ছিল যে, নিজের নফসের জন্য রাগ করে অন্যের কাজ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। 

শুনলো নুকসান হি হোতা হে বিল আখির উনকো
নফসকে ওয়াস্তে গুস্সা জু কিয়া করতে হে।

صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد


কারো প্রতি রাগ আসলে এভাবে চিকিৎসা করুন

রাগের ধ্বংসাত্বক দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখুন। কেননা রাগ অধিকাংশ ঝগড়া-বিবাদ, দু-ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক, পারষ্পরিক নিন্দা ও হত্যার মত জঘন্যতম কাজের মূল কারণ। যখন কারো রাগ আসে এবং মারধর ও ভাংচুর করতে ইচ্ছা করে তখন আপনি নিজেকে এভাবে বুঝাতে চেষ্টা করবেন যে, অন্যের উপর যদিও আমার কিছু ক্ষমতা প্রয়োগ করার শক্তি আছে, কিন্তু তার চেয়ে বহু গুণে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেন আল্লাহ তাআলা। যদি আমি রাগের কারণে কারো মনে দুঃখ দিয়ে থাকি বা কারো হক নষ্ট করে থাকি, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার গযব (রাগ) থেকে কিভাবে রক্ষা পাব?

গোলাম দেরী করেছে

শাহানশাহে দোআলম, নুরে মুজাসসাম, নবী করীম صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এক গোলাম কে কোন কাজে ডেকেছেন। সে (গোলাম) দেরীতে হাজির হল।এমতাবস্থায় হুজুরে আনোয়ার صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর নূরানী হাতে মিসওয়াক ছিল, ইরশাদ করলেন:  যদি কিয়ামতের ময়দানে প্রতিশোধ গ্রহণ করা না হতো, তাহলে আমি তোমাকে এ মিসওয়াক দিয়ে মারতাম। (মসনদে আবি ইয়ালা, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-৯০, হাদীস-৬৮৯২)

দেখলেন তো আপনারা! আমাদের প্রিয় আকা শাহিনশাহে খাইরুল আনাম صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم কখনো নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। আর আজকের মুসলমানদের অবস্থা দেখুন, যদি কর্মচারী কোন কাজে সামান্যতম কোন ভুল করে বসে তবে গালি গালাজের সাথে সাথে নির্যাতনের চরম অবস্থা তার উপর তুলে দেয়।

প্রহারের কাফ্ফারা

মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত সায়্যিদুনা আবু মাসউদ আনছারী رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ বণর্না করেন, একদা আমি স্বীয় গোলাম কে প্রহার করতে ছিলাম, এমতাবস্থায় আমার পিছন থেকে আওয়াজ শুনলাম “হে  আবু মাসউদ! তোমার এ কথাটুকু খুব ভাল করে জেনে রাখা উচিত যে, তুমি এর উপর যতটুকু ক্ষমতা রাখ তার চেয়েও বেশী আল্লাহ তাআলা তোমার উপর ক্ষমতা রাখেন। আমি পিছনে ফিরে দেখলাম তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم! সে (প্রহারকৃত গোলাম) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুক্ত। সরকারে মদীনা, নবী করীম صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “তুমি যদি তা না করতে তাহলে তোমাকে দোযখের আগুন স্পর্শ করত।” (ছহীহ মুসলিম, পৃষ্ঠা-৯০৫, হাদীস-১৬৫৮৩৫)

صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد

ক্ষমার মধ্যেই নিরাপত্তা রয়েছে

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আপনারা দেখলেন তো! আমাদের সাহাবায়ে কেরামগণ عَلَيْهِمُ الرِّضْوَان আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم কে কিভাবে ভালবাসতেন। হযরত সায়্যিদুনা আবু মাসউদ আনসারী رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ যখনি নিজ প্রিয় আকা মাহবুবে খোদা صَلَّی اللّٰہُ  تَعَالٰی عَلَیْهِ  وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর অসন্তুষ্টি অনুভব করতে পারলেন। তাৎক্ষণিক ভাবে শুধু মাত্র গোলামকে প্রহার করা থেকে বিরত থেকেছেন তা নয়, বরং উক্ত ভুল বুঝতে পেরে সে ভুলের কাফ্ফারা স্বরুপ গোলামকে আযাদ করে দিলেন। আহ! আজকাল মানুষ নিজের অধীনে কর্মচারীদেরকে শরীয়তের অনুমতি ছাড়া গালি-গালাজ, প্রহার, জুলুম-নির্যাতনের মত অমানবিক আচরণ করতে বিন্দুমাত্র একথার প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছেনা যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের থেকে বেশী ক্ষমতার অধিকারী। তিনি আমাদের জুলুম-নির্যাতন সব কিছু দেখছেন। নিঃসন্দেহে নিজের মাতেহাতের (অধীনস্ত) সাথে নম্রতা ও উত্তম আচরণ এবং ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে কাজ করার মধ্যে নিরাপত্তা রয়েছে।

লবণ অতিরিক্ত দিয়েছেন

কথিত আছে যে, এক ব্যক্তির স্ত্রী খাবারের মধ্যে লবণ অতিরিক্ত দিয়েছে। সে লোকটির রাগ এল। কিন্তু তারপরও এটা ভেবে উক্ত রাগ দমন করে ফেলল যে, আমিও ভুল করি, অপরাধ করি। আজ যদি আমি আমার স্ত্রীর ভুলের কারণে তাকে কঠোরতা দেখিয়ে শাস্তি প্রদান করি তাহলে কখনও যাতে এমন না হয় যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলাও আমার পাপ ও দোষ ত্রুটির কারণে আমাকেও শাস্তি প্রদান করবেন। তাই এ কথা ভেবে সে তার স্ত্রীর প্রতি সদয় হল। ক্ষমা প্রদর্শন করল। মৃত্যুর পর তাকে কেউ স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহ তাআলা তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তিনি উত্তর দিলেন! ইহকালে আমার পাপের কারণে শাস্তির উপযুক্ত ছিলাম, তবে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করলেন:
“আমার বান্দি তরকারীতে লবণ বেশী দিয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলে। যাও! আমি ও আজ তার সাথে তোমার ব্যবহারের কারণে তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।”
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد

--------
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত ২৪ পৃষ্ঠা সম্বলিত "রাগের চিকিৎসা" নামক রিসালার ২-১৩ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই রিসালাটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখুন। অন্যকে উপহার দিন। 
যারা মোবাইলে (পিডিএফ) রিসালাটি পড়তে চান তারা ফ্রি ডাউনলোড করুন ।
ইসলামীক বাংলা বইয়ের লিংক এক সাথে পেতে এখানে ক্লিক করুন
মাদানী চ্যানেল দেখতে থাকুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for supporting.