স্বর্ণের দরজা বিশিষ্ট মহল
বাকী পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব
সায়্যিদুনা আবূ সাঈদ খুদরী رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, মক্কী মাদানী সুলতান, রহমতে আলামিয়ান হযরত মুহাম্মদ ﷺ রহমতপূর্ণ বাণী হচ্ছে, “যখন রমযান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন আসমানগুলো ও জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। আর সেগুলো সর্বশেষ রাত পর্যন্ত বন্ধ হয় না। যে কোন বান্দা এ বরকতময় মাসের যে কোন রাতে নামায পড়ে, তবে আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি সিজদার পরিবর্তে (অর্থাৎ বিনিময় স্বরূপ) তার জন্য পনের শত নেকী লিপিবদ্ধ করেন। আর তার জন্য জান্নাতে লাল পদ্মরাগ পাথরের মহল তৈরী করেন, যার ষাট হাজার দরজা থাকবে, প্রতিটি দরজার কপাট স্বর্ণের তৈরী হবে, যাতে লাল বর্ণের পদ্মরাগের পাথর খচিত থাকবে। সুতরাং যে কেউ রমযানের প্রথম রোযা রাখে তার জন্য আল্লাহ তাআলা রমযানের শেষ দিন পর্যন্ত গুনাহ মাফ করে দেন এবং তার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশতা মাগফিরাতের দু‘আ করতে থাকে। রাত ও দিনে যখনই সে সিজদা করে তার ওই প্রতিটি সিজদার বিনিময়ে তাকে (জান্নাতে) একেকটা এমন গাছ দান করা হবে, সেটার ছায়া অতিক্রম করতে ঘোড়ার আরোহীকে পাঁচশ বছর দৌঁড়াতে হবে।” (শু‘আবুল ঈমান, খন্ড-৩য়, পৃষ্ঠা-৩১৪, হাদিস-৩৬৩৫)
রমযানের ফযিলত |
আমি একজন চিত্রশিল্পী ছিলাম
আওরঙ্গি টাউন বাবুল মদীনা করাচী এর এক ইসলামী ভাইয়ের বর্ণনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে : আফসোস! শত সহস্র আফসোস!! আমি একজন চিত্রশিল্পী ছিলাম। মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম ও ফ্যাশনের কাজ করতে করতে আমার জীবনের খুব মূল্যবান সময় বরবাদ হয়ে যাচ্ছিল। অন্তর ও মস্তিস্কের মধ্যে এমন অলসতার পর্দা পড়ে গিয়েছিল যে, নামায পড়ার সৌভাগ্য হত না, গুনাহ করার পরও অনুশোচনা জাগত না। সাহরায়ে মদীনা টুল প্লাজা সুপার হাইওয়ে বাবুল মদীনা করাচীতে বাবুল ইসলামে অনুষ্ঠিত তিন দিনের সুন্নতে ভরা ইজতিমায় (১৪২৪ হিজরী ২০০৩ ইং) অংশগ্রহণ করার জন্য এক জিম্মাদার ইসলামী ভাই ইনফিরাদী কৌশিশ করে আমাকে খুব উৎসাহিত করেন। সৌভাগ্যের বিষয়! তাতে শরীক হওয়ার সৌভাগ্য নসীব হল। তিন দিনের ইজতিমা শেষে হৃদয়গ্রাহী দুআতে আমার নিজের বিগত গুনাহের উপর খুবই ঘৃণা ও অনুশোচনা হল। আমি আমার জযবাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, খুব কাঁদলাম। আর এই কাঁদাটা আমার কাজে এসে গেল। اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَزَّوَجَلّ আমার দা’ওয়াতে ইসলামীর মাদানী মহল মিলে গেল। আমি গান-বাজনা ও আনন্দ উৎসবের অনুষ্ঠান থেকে তওবা করলাম এবং মাদানী কাফিলায় সফর করাকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিলাম। ২৫শে ডিসেম্বর ২০০৪ ইং তারিখে আমি যখন মাদানী কাফিলায় সফর করার জন্য রওয়ানা হচ্ছিলাম তখন আমার ছোট বোনের ফোন আসল। সে বুক ভরা কান্নার আওয়াজে আমাকে তার এক অন্ধ মেয়ের জন্মের সংবাদ শুনাল। আর সাথে এটাও বলল যে, ডাক্তাররা বলেছেন যে, এই বাচ্চার কখনো দৃষ্টিশক্তি আসবে না। ততটুকু বলেই তার কথা আটকে গেল এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি এতটুকু বলে তাকে সান্ত্বনা দিলাম যে, اِنْ شَاءَ الله عَزَّوَجَلّ মাদানী কাফিলায় দুআ করব। আমি মাদানী কাফিলায় নিজে খুব দুআ করলাম এবং আশিকানে রসূলদের দিয়েও দুআ করালাম, যখন মাদানী কাফিলা থেকে ফিরে আসলাম তখন ফিরার দ্বিতীয় দিন আমার ছোট বোনের আনন্দে ভরা হাসি মিশ্রিত ফোন আসল এবং সে খুশি মনে এই আনন্দের সংবাদটুকু শুনাল যে, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ عَزَّوَجَلّ َআমার অন্ধ মেয়ের চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে এবং ডাক্তাররা এই বলে আশ্চর্য হল যে, এটা কিভাবে হল! কেননা আমাদের চিকিৎসার বিজ্ঞানে এর কোন চিকিৎসাই ছিল না।
এই বর্ণনা দেয়াকালে আমি বাবুল মদীনা করাচীর এলাকায়ী মুশাওয়ারাত এর একজন রোকন হিসেবে দা’ওয়াতে ইসলামীর মাদানী কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করছি।
আফাতু ছে না ডর, রাখ করম পর নজর
রৌশন আখে মিলে, কাফিলে মে চলো।
আপকো ডাক্টর, নে গো মায়ুস কর,
ভী দিয়া মত ঢরে কাফিলে মে চলো।
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আপনারা শুনলেন তো! দা’ওয়াতে ইসলামীর মাদানী মহল কতই প্রিয়! এর সংস্পর্শে এসে সমাজের না জানি কত অসংখ্য পথহারা মানুষ সৎচরিত্রবান হয়ে সুন্নতে পরিপূর্ণ সম্মানের জীবন অতিবাহিত করছে! আর মাদানী কাফিলার বাহারতো আপনাদের সামনেই আছে। যেভাবে মাদানী কাফিলায় সফরের বরকতে অনেকের দুনিয়াবী সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সেভাবে তাজেদারে রিসালাত, শাহানশাহে নুবুওয়াত, শফীয়ে উম্মত, হযরত মুহাম্মদ ّصَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর সুপারিশে আখিরাতের বিপদগুলোও আনন্দে সুখে পরিণত হয়ে যাবে।
টুট যায়েগে গুনাহগারো কে ফাওরান কয়দো বন্দ,
হাশর কো খুল যায়েগি তাকত রসুলুল্লাহ কি।
পাঁচটি বিশেষ দয়া
হযরত সায়্যিদুনা জাবির ইবনে আবদুল্লাহ رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, রহমতে আলামিয়ান হাবীবে রহমান হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর মর্যাদাপূর্ণ বাণী হচ্ছে- “আমার উম্মতকে রমযান মাসে পাঁচটি এমন জিনিস দান করা হয়েছে, যেগুলো আমার পূর্বে অন্য কোন নবী পাননি ”
১. যখন রমযানুল মুবারকের প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। আর যার প্রতি আল্লাহ রহমতের দৃষ্টি দেন তাকে কখনো আযাব দেবেন না।
২. সন্ধ্যায় তাদের মুখের দুর্গন্ধ (যা ক্ষুধার কারণে সৃষ্টি হয়) আল্লাহ তা’আলা এর নিকট মেশকের চেয়েও বেশি সুগন্ধি হয়।
৩. ফিরিশতাগণ প্রত্যেক দিনে ও রাতে তার জন্য মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকেন।
৪. আল্লাহ তা’আলা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ ফরমান, “আমার নেক বান্দাদের জন্য সুসজ্জিত হয়ে যাও! শীঘ্রই তারা দুনিয়ার কষ্টের বিনিময়ে আমার ঘর ও দয়ার মধ্যে শান্তি পাবে।”
৫. যখন রমযান মাসের সর্বশেষ রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা সবাইকে ক্ষমা করে দেন।”
উপস্থিতদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আরয করলেন, “হে আল্লাহর রসূল ﷺ এটা কি ‘লাইলাতুল ক্বদর?” ইরশাদ ফরমালেন, “না”। তোমরা কি দেখনি যে, শ্রমিকগণ যখন নিজের কাজ সম্পন্ন করে নেয়, তখন তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া হয়?” (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৫৬, হাদীস-৭)
সগীরা’ গুনাহের কাফফারা
হযরত সায়্যিদুনা আবু رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, হুযুর পুরনূর, শাফিয়ে ইয়াউমুন নূশুর হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর আনন্দদায়ক ফরমান, “পাঁচ ওয়াক্তের নামায, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত, এক রমযান মাস থেকে পরবর্তী রমযান মাস পর্যন্ত গুনাহ্ সমূহের কাফফারা হয়ে যায়, যতক্ষণ কবীরা গুনাহ্ থেকে বিরত থাকা হয়।” (সহীহ মুসলিম, খন্ড-১ম, পৃ-১৪৪, হাদীস নং-২৩৩)
তওবার পদ্ধতি
سُبْحٰنَ اللهِ عَزَّوَجَل! রমযানুল মুবারকে রহমতের মুসলধারে বৃষ্টি ও সগীরা গুনাহ্ সমূহের কাফফারার মাধ্যম হয়ে যায়। ‘কবীরা’ গুনাহ তওবা মাধ্যমে ক্ষমা হয়ে যায়।
তওবা করার পদ্ধতি হচ্ছে
যে গুনাহ্ হয়েছে, বিশেষভাবে ওই গুনাহ্ উল্লেখ করে মনে মনে তার প্রতি ঘৃনা ও ভবিষ্যতে সেটা থেকে বেঁচে থাকার অঙ্গীকার করে তওবা করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, মিথ্যা বললে, এটা ‘কবীরা গুনাহ্।’
সুতরাং আল্লাহ তাআলার মহান দরবারে আরয করবে, “হে আল্লাহ! আমি এ যে মিথ্যা বলেছি, তা থেকে তওবা করছি। ভবিষ্যতে বলবোনা।” তওবা করার সময় অন্তরে মিথ্যা বলার প্রতি ঘৃণা, আর ‘ভবিষ্যতে বলবো না’ কথাটা বলার সময় অন্তরে এ দৃঢ় ইচ্ছাও থাকবে যে, ‘যা কিছু মুখে বলছি, তেমনি করবো।’ তখনই হবে ‘তওবা’। যদি বান্দার হক বিনষ্ট করে থাকে, তবে তওবার সাথে সাথে ওই বান্দার নিকট থেকে ক্ষমা করিয়ে নেয়াও জরুরী।
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
تُوْبُوْا اِلَى الله! اَسْتَغْفِرُ الله
صَلُّوا عَلَى الحَبِيب ! صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلى مُحَمَّد
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! হাদিস শরীফের কিতাব সমূহে রমযান শরীফের ফযীলতসমূহ যথেষ্ট পরিমাণে বর্ণিত হয়েছে। রমযানুল মুবারকে এতো বেশি পরিমাণ বরকত ও রহমত রয়েছে যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْهِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এ পর্যন্ত ইরশাদ করেছেন যে, যদি বান্দাগণ জানতো রমযান কি, তাহলে আমার উম্মত আশা করতো, “আহা! গোটা বছরই যদি রমযান হতো?” (সহীহ ইবনে খুযাইমা, খন্ড-৩য়, পৃ-১৯০, হাদীস নং-১৮৮৬)
হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর জান্নাতরূপী বর্ণনা
হযরত সায়্যিদুনা সালমান ফারসী رضى الله عنه বলেন, মাহবুবে রহমান হযরত মুহাম্মদ ﷺ শা’বান মাসের শেষ দিনে ইরশাদ করেছেন, “হে লোকেরা! তোমাদের নিকট মহান ও বরকতময় মাস এসেছে। মাসটি এমন যে, তাতে একটি রাত (এমনি) রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। এ (বরকতময়) মাসের রোযা আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন। আর সেটার রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী করা ‘তাতাওভু’(এখানে রাতে জাগ্রত রয়ে ইবাদত করা অর্থাৎ তারাবীর নামায পড়া। এটা সুন্নত) যে ব্যক্তি এতে নেক কাজ (নফল ইবাদত) করলো, তা হলো ফরয ইবাদতের সমান। আর যে ব্যক্তি ফরয আদায় করেছে, তা হলো সত্তর ফরযের সমান। এ মাস ধৈর্যের। আর ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। আর এ মাস হচ্ছে সমবেদনা প্রকাশ ও উপকার করার মাস। এ মাসে মু’মিনদের জীবিকা বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এতে রোযাদারকে ইফতার করায়, তা তার গুনাহ্ সমূহের জন্য (মাগফিরাত)। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেয়া হবে। আর যে ইফতার করায় সে তেমনি সাওয়াব পাবে যেমন পাবে রোযা পালনকারী, তার রোযা পালনকারীর সাওয়াবে কোনরূপ কম হবে না। আমরা আরয করলাম, “হে আল্লাহর রসূল ﷺ! আমাদের মধ্যে প্রত্যেকের এমন জিনিস নেই, যা দিয়ে ইফতার করাবে, হুযুর ﷺ ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’আলা এ সাওয়াব ওই ব্যক্তিকে দেবেন, যে এক ঢোক দুধ, কিংবা একটা খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারা রোযাদারকে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি রোযাদারকে পেট ভরে আহার করায়, তাকে আল্লাহ তা’আলা আমার ‘হাওয’ থেকে পান করাবেন। ফলে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। শেষ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা হচ্ছে ওই মাস, যার প্রথমাংশ (অর্থাৎ-প্রথম দশদিন) ‘রহমত’, সেটার মধ্যভাগ (অর্থাৎ মধ্যভাগের দশদিন) ‘মাগফিরাত’ এবং শেষাংশ (অর্থাৎ শেষ দশদিন) ‘জাহান্নাম থেকে মুক্তি (নাজাত)’।
যে ব্যক্তি তার কর্মচারীর উপর এ মাসে কাজকর্ম সহজ করে দেয়, আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। এ মাসে চারটি কাজ বেশি পরিমাণে কর, সেগুলোর দু’টি হচ্ছে এমন যে, সে দুটি দ্বারা তোমরা আপন রবকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। আর অবশিষ্ট দুটির প্রতি তো তোমরাই মুখাপেক্ষী।
সুতরাং যে দু’টি কাজ দ্বারা তোমরা আপন প্রতিপালককে সন্তুষ্ট— করতে পারবে, সে দুটি হচ্ছে-
১. “আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই” মর্মে সাক্ষ্য দেয়া এবং
২. ক্ষমা প্রার্থনা করা।
আর যে দুটি থেকে তোমরা বাঁচতে পারো না, সেগুলো হচ্ছে-
১. আল্লাহ তা’আলার মহান দরবারে জান্নাত আশা করা এবং
২. জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তা’আলার আশ্রয় প্রার্থনা করা। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, পৃষ্ঠা-১৮৮৭, খন্ড-৩য়)
রমযান মুবারকের চারটি নাম
আল্লাহু আকবর! মাহে রমযানেরও কেমন কল্যাণ! হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رحمة الله عليه ‘তাফসীরে নঈমী’ শরীফে বর্ণনা করেন, “এ বরকতময় মাসের সর্বমোট চারটি নাম রয়েছে-১. মাহে রমযান, ২. মাহে সবর, ৩. মাহে মুওয়াসাত (সমবেদনা জ্ঞাপন ও উপকার সাধনের মাস) এবং ৪. মাহে ওয়াসআতে রিয্ক (জীবিকা প্রশস্ত হবার মাস)।” তিনি আরো লিখেছেন, “রোযা হচ্ছে ধৈর্য, যার প্রতিদান- খোদ মহান আল্লাহ। আর তা এই মাসেই পালন করা হয়। এ কারণে সেটাকে ‘মাহে সবর’ বলা হয়। ‘মুওয়াসাত’ মানে উপকার করা। যেহেতু, এ মাসে সমস্ত মুসলমানের সাথে, বিশেষ করে পরিবার-পরিজন ও নিকটাত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করা বেশি সাওয়াবের কাজ। তাই সেটাকে ‘মাহে মুওয়াসাত’ বলা হয়। এতে জীবিকা প্রশস্ত হয়। ফলে গরীবরাও নে’মত ভোগ করে। এজন্য এর নাম রিযিক প্রশস্ত হওয়ার মাসও। (তাফসীরে নঈমী, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-২০৮)
প্রতিটি রাতে ষাট হাজার গুনাহগারের মুক্তি লাভ
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, মক্কী-মাদানী সুলতান, রহমতে আলামিয়ান, হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর রহমতপূর্ণ ফরমান, “রমযান শরীফের প্রতিটি রাতে আসমানে সুবহে সাদিক পর্যন্ত একজন আহ্বানকারী এ বলে আহ্বান করে, “হে কল্যাণকামী! আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যের দিকে অগ্রসর হও এবং পরিপূর্ণ কর! অর্থাৎ আনন্দিত হয়ে যাও! ওহে অসৎকর্মপরায়ণ! অসৎকর্ম থেকে বিরত হও এবং শিক্ষা গ্রহণ করো। কেউ মাগফিরাত চাওয়ার আছো কি? তার দরখাস্ত পূরণ করা হবে। কেউ তওবাকারী আছো কি? তার তওবা কবুল করা হবে। কেউ প্রার্থনাকারী আছো কি? তার দু’আ কবুল করা হবে। কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা করারও কেউ আছো কি? তার প্রার্থনা পূরণ করা হবে। আল্লাহ তা’আলা রমযানুল মুবারকের প্রতিটি রাতে ইফতারের সময় ষাট হাজার গুনাহগারকে দোযখ থেকে মুক্তি দান করেন। আর ঈদের দিন সমগ্র মাসের সমসংখ্যক গুনাহগারকে ক্ষমা করা হয়।”(দুররে মনসুর, খন্ড-১ম, পৃ-১৪৬)
প্রতিদিন দশলক্ষ গুনাহগারকে দোযখ থেকে মুক্তিদান
আল্লাহ তা’আলার দান, দয়া ও ক্ষমার কথা উল্লেখ করে এক জায়গায় তাজেদারে মদীনা, সুরুরে কলবো সীনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেছেন, “যখন রমযানের প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তা’আলা আপন সৃষ্টির দিকে দয়ার দৃষ্টি দেন। বস্তুত: যখন আল্লাহ কোন বান্দার দিকে দয়ার দৃষ্টি দেন, তাকে কখনো আযাব দেবেন না। আর প্রতিদিন দশলক্ষ (গুনাহগারকে) জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। (এভাবে) যখন ঊনত্রিশতম রাত আসে তখন গোটা মাসে যতসংখ্যক লোককে মুক্তিদান করেছেন, তার সমসংখ্যক মানুষকে ওই রাতে মুক্তিদান করেন। অতঃপর যখন ঈদুল ফিতরের রাত আসে তখন ফিরিশতাগণ আনন্দ প্রকাশ করে। আর আল্লাহ তাআলা আপন নূরকে বিশেষভাবে বিচ্ছুরিত করেন এবং ফিরিশতাদেরকে বলেন, “হে ফিরিশতারদল! ওই শ্রমিকদের কি প্রতিদান হতে পারে, যে তার দায়িত্ব পালন করেছে? ফিরিশতাগণ আরয করেন, “তাকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দেয়া হোক।” আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান, “আমি তোমাদেরকে সাক্ষী করছি-আমি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।” (কানযুল উম্মাল, খন্ড-৮ম, পৃ-২১৯, হাদীস নং-২৩৭০২)
জুমার দিনের প্রতিটি মুহুর্তে দশ লক্ষ জাহান্নামীর মাগফিরাত
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস رضى الله عنهم থেকে বর্ণিত, মাহবুবে রাব্বিল আলামীন, সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর আনন্দদায়ক ফরমান, “আল্লাহ মাহে রমযানে প্রতিদিন ইফতারের সময় এমন দশলক্ষ গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন, যাদের গুনাহের কারণে জাহান্নাম অনিবার্য (ওয়াজিব) হয়েছিলো। অনুরূপভাবে, জুমার রাতে ও জুমার দিনে (অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সূর্যাস্ত থেকে আরম্ভ করে জুমার দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত) প্রতিটি মুহুর্তে এমন দশলক্ষ গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়, যারা শাস্তির উপযোগী বলে সাব্যস্ত হয়েছিল।” (কানযুল উম্মাল, খন্ড-৮ম, পৃষ্ঠা-২২৩, হাদীস নং-২৩৭১৬)
কল্যাণই কল্যাণ
আমীরুল মু’মিনীন হযরত সায়্যিদুনা উমর ফারুক رضى الله عنه বলেন,“ওই মাসকে স্বাগতম, যা আমাদেরকে পবিত্রকারী! গোটা রমযান মাস কল্যাণই কল্যাণ। দিনের বেলায় রোযা হোক, কিংবা রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত। এ মাসে ব্যয় করা জিহাদে অর্থ ব্যয় করার মত মর্যাদা রয়েছে।” (তাম্বীহুল গাফিলীন, পৃষ্ঠা-১৭৬)
ব্যয়কে বাড়িয়ে দাও
হযরত সায়্যিদুনা দ্বামুরা رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, নবী করীম রাউফুর রাহীম হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর মহান বাণী হচ্ছে, “মাহে রমযানে পরিবারের লোকজনের ব্যয়কে বাড়িয়ে দাও। কেননা, মাহে রমযানে খরচ করা আল্লাহ তা’আলার রাস্তায় খরচ করার মতোই।”(আল জামেউস সাগীর, পৃষ্ঠা-১৬২, হাদিস-২৭১৬)
বড় বড় চক্ষু বিশিষ্ট হুরেরা
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস رضى الله عنه থেকে বর্ণিত, নবী করীম রউফুর রাহীম হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর মহান বাণী হচ্ছে“যখন রমযান শরীফের প্রথম তারিখ আসে, তখন মহান আরশের নিচে থেকে মাসীরাহ নামক বাতাস প্রবাহিত হয়, যা জান্নাতের গাছপালাকে নাড়া দেয়। ওই বাতাস প্রবাহিত হবার কারণে এমনি মনোরম উচ্চস্বর ধ্বনিত হয়, যার চেয়ে উত্তম সুর আজ পর্যন্ত কেউ শুনেনি। ওই সুর শুনে (সুন্দর চোখ বিশিষ্ট) হুরেরা বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত তারা জান্নাতের উঁচু উঁচু মহলগুলোর উপর দাঁড়িয়ে যায়। আর বলে, “কেউ আছো, যে আল্লাহ তা’আলার দরবারে আমাদের প্রার্থী হবে, যাতে তার সাথে আমাদের বিবাহ হয়?” তারপর ওই হুরগুলো জান্নাতের দারোগা (হযরত) রিদ্বওয়ান عليه السلام কে বলে, “আজ এ কেমন রাত?” হযরত রিদ্বওয়ান عليه السلام তদুত্তরে বলে, “হাঁ! এটা মাহে রমযানের প্রথম রাত। জান্নাতের দরজাগুলো হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর উম্মতের রোযাদারের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।” (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৬০, হাদীস-২৩)
দুটি অন্ধকার দূরীভূত হয়
বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত সায়্যিদুনা মূসা কলীম উল্লাহ عليه السلام কে বলেন, আমি উম্মতে মুহাম্মদী ﷺ কে দুটি ‘নূর’ (জ্যোতি) দান করেছি। যাতে তারা দু’টি অন্ধকারের বিপদ থেকে নিরাপদে থাকে। সায়্যিদুনা মুসা কলীম উল্লাহ عليه السلام আরয করলেন, “হে আল্লাহ! ওই নূর দু’টি কি কি?” ইরশাদ হলো, “রমযানের নূর” ও “কোরআনের নূর”।”সায়্যিদুনা মুসা কলীম উল্লাহ عليه السلام আরয করলেন, অন্ধকার দু’টি কি কি?” বললেন, “একটা কবরের, আর অপরটা কিয়ামতের।” (দুররাতুন্নাসিহীন, পৃষ্ঠা-৯)
--------
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত রযমান মাসের বিস্তারিত মাসাইল সম্পর্কিত “রমযানের ফযিলত” নামক কিতাবের ৫-২২ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। কিতাবটি নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।
যারা মোবাইলে (পিডিএফ) কিতাবটি পড়তে চান তারা ফ্রি ডাউনলোড দিন